স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার প্রাধান্য বেশি ছিল, যা বণিক বার্তার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটার প্রাধান্য বেশি ছিল, যা বণিক বার্তার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিল। তারা কোটা সংস্কার করে যৌক্তিক করার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেছে। তবে তা ২০১৮ সালে বড় আকার ধারণ করে। তখন তৎকালীন সরকারপ্রধান ১১ এপ্রিল সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেয়। সে বছরের অক্টোবরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদগুলোয় কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা থেকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরপর আন্দোলন থেমে গিয়েছিল। কিন্তু কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ জুন আগের মতোই কোটা বহালের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। এর প্রতিবাদে ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনের মর্মকথা ছিল অযৌক্তিক কোটার যৌক্তিকীকরণ এবং মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার।
যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে জুলাই অভ্যুত্থানের সূত্রপাত, তার মূল দাবিটি ছিল সরকারি চাকরিতে অযৌক্তিক কোটার যৌক্তিকীকরণ ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা। আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ও নির্বিচার গুলিতে প্রায় ২ হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা এ আন্দোলনকে রূপ দেয় গণ-অভ্যুত্থানে। পতন ঘটে স্বৈরাচারী শাসকের।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাই হচ্ছে মেধার প্রাধান্য। সরকারি চাকরিতে মেধার প্রাধান্য নিশ্চিত করতেই এ আন্দোলন ও এত মানুষের আত্মত্যাগ। অন্তর্বর্তী সরকার চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ফসল। তাই অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন এ সরকারের কর্মকাণ্ডে মেধার প্রাধান্য পাবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব ঘুচবে। কিন্তু সেই কোটা প্রথার সংস্কৃতি আবারো লক্ষ করা যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর কোটা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ও শহীদদের স্বজনদের অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সর্বশেষ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। সুবিধা দেয়ার এ নীতিকে পুরনো কোটা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা বলছেন, তাদের আন্দোলন ছিল কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এজন্য তারা জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সে কোটা আর কখনই ফিরে না আসুক, সেটাই তাদের চাওয়া। তবে অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের এককালীন বা মাসিক ভাতাসহ চাহিদামাফিক বিভিন্নভাবে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চাহিদামাফিক সহযোগিতার মাধ্যমে অবশ্যই রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু কোনোভাবেই চাকরিতে কোটা বা বিশেষ সুবিধা দিয়ে নয়।
সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠানে পদসংখ্যা খুবই কম। একদিকে পদসংখ্যা কম, অন্যদিকে বিগত সময়ে কোটার প্রাধান্য থাকায় মেধাবীদের তুমুল প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। তার পরও অনেকের কপালে জোটেনি সরকারি চাকরি। অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা বহুমাত্রিক। এ খাত অর্থনীতিতে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান প্রায় ৮৬ শতাংশ। এ খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেসরকারি খাতে আশানুরূপ বিনিয়োগ নেই। গত এক দশকের মধ্যে এ মুহূর্তে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কম থাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও বেকারত্ব বাড়ছে। দেশে বেকার আছে কি নেই বা কর্মসংস্থানের বাস্তব অবস্থা কী—সেটা এখন বিতর্কের বিষয় নয়। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরির বিপরীতে আবেদনের সংখ্যা হিসাব করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি পদের বিপরীতে অনেক প্রার্থীকে আবেদন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে অর্থাৎ শ্রমশক্তি জরিপের ত্রৈমাসিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২৪) প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সাল শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা সাড়ে ২৫ লাখ। গত বছর বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত বেকারের সংখ্যা আরো বেশি।
কোনো একটা দেশের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ হিসাবায়নে জনমিতির একটি লভ্যাংশের কথা বিবেচনা করা হয়। একটি দেশের জনসংখ্যা যদি বয়স কাঠামোর বিবেচনায় প্রবৃদ্ধিসহায়ক ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। একটি দেশের জনসংখ্যাকে সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কর্মক্ষম জনসংখ্যা এবং অন্যটি হচ্ছে নির্ভরশীল জনসংখ্যা। কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বা সংখ্যা যদি নির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা যেতে পারে। অর্থনীতির পরিভাষায় কর্মক্ষম জনসংখ্যা বলতে ১৫-৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত জনসংখ্যাকে বোঝায়। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম। এ কর্মক্ষম বিশাল জনসংখ্যাকে যদি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল কাজে লাগানো সম্ভব হবে। কর্মক্ষম জনসংখ্যার যদি উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তা দেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিরাট সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষের জন্য তাই আনুষ্ঠানিক খাত অথবা অনানুষ্ঠানিক খাতে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা বেশি। এ নির্ভরশীলতা কমাতে হলে বেসরকারি খাতকে গতিশীল করতে হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা সুবিধা বা বিশেষ সুবিধা বন্ধ করে মেধাকে মূল্যায়ন করা উচিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শোভন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক চাকরি নয়, সারা দেশে এ সুযোগ তৈরি করতে হবে। তরুণদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। সর্বোপরি কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার বিকাশে সরকার, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিতভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।