রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশনের আনা প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পরিমান ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি হবে। ধরা যাক, সেটি হয়ে গেছে। বাস্তবায়ন করবে কে? কখন করবে? কিভাবে করবে? গত ক’দিনের নমুনা বলছে, সামনের সরকার তার মতো করে সেই দলিল-সনদ দেখবে। ক্ষমতার বাইরের দলগুলো চাপ দেবে, মনে করিয়ে দেবে। তাও নিজেদের মতো করে। দলগুলোকে দেওয়া সনদের খসড়া ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে গোলমাল বাধার খবর মানুষকে ব্যথিত করছে। ভেতরে ভেতরে এতো মতভিন্নতা-বিরোধ নিয়ে যে তারা এখনো বসেন, মোলাকাত করেন, ফটো সেশন করেন, তা মানুষকে ভাবাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ কিছু দল এখন সমরৈখিকে। তা প্রকাশ্যেই জানানো হয়েছে। সংস্কার নিয়ে কচলানি কথামালা চলছে ১০ মাস ধরে। অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন হয়। কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয় গত ফেব্রুয়ারিতে। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে আইনবিধি সংস্কার করে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব, এমন অনেক সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন।
প্রথম পর্বে ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পৃথক আলোচনা করে কমিশন। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি, এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবগুলোকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে এখন পর্যন্ত ১৩টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ নিয়ে প্রায়ই নাটকীয়তা। কড়া কথা, ওয়াক আউট। নানা বিরোধ-বিরক্তির মাঝে বিএনপি থেকে ক্ষোভের সঙ্গে জানানো হয়েছে , সংস্কারের নামে খানাপিনাই বেশি হচ্ছে। কাজের কাজ তেমন হচ্ছে না। এরপরও কাজ চলছে। হচ্ছে বৈঠকের পর বৈঠক। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, নির্বাচন পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে কোনো কথাই শেষ হয়েও হয় না শেষ। কথা থেকেই যায়। আবার কিছু বিষয়ে একমত হওয়ার তথ্যও জানানো হয়। দ্বিতীয় পর্বে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, এমন বিষয়ের মধ্যে রয়েছে এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন; সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান; হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যায়ে নি¤œ আদালত স্থানান্তর; সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি; জরুরি অবস্থা জারিসংক্রান্ত; প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; ইসি গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করা; পুলিশ কমিশন গঠন; প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান।
এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে, একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না। এ প্রস্তাবে তিন-চতুর্থাংশ দল একমত। এগুলোর মধ্যে সেসব বিষয়ে বিএনপিসহ যারা একমত হয়নি, তারা জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবে। ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে ন্যূনতম ৫ শতাংশ বর্ধিত হারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন অব্যাহত থাকবে। এটিও সংবিধানে যুক্ত হবে। সংরক্ষিত নারী আসন ২০৪৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০টি থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা এবং সেখানে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল সংস্কার কমিশন। সংস্কারের মাঝে মৌলিক-যৌগিক ভাগও রয়েছে। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জোরালো আপত্তি আছে বিএনপির। তারা এসংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত না করে আইনের মাধ্যমে নিয়োগ করার পক্ষে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে অর্থাৎ সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে তারা উচ্চকক্ষে আসন পাবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল এই প্রস্তাবে একমত। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের এতে আপত্তি আছে। উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কী হবে, তা নিয়েও মতভিন্নতা আছে। এমন পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে কমিশনকে একটি সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভার দেওয়া হয়েছিল।
রাষ্ট্রের মূলনীতি প্রশ্নেও দলগুলোর মাঝে বেশ বিভক্তি। এসব বিভক্তি জিইয়ে রাখার ভবিষ্যত কী হবে বা হতে পারে, সেই দৃষ্টান্ত দেশে আছে। তা আগামীতে কোথায় গড়াবে, এ নিয়েও কথা আছে। বর্তমান এবং সদ্য অতীত নিয়েই চলছে নানান ফ্যাকড়া। জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী ছিল, প্রশ্নটি নতুন করে টেনে আনা হয়েছে। এতে কার কৃতিত্ব বেশি, এ বিতর্ক দোষের নয়। ভালো কিছুর কৃতিত্ব নেয়ার একটি অভিপ্রায় সবার মাঝেই কাজ করে। সেটা করতে গিয়ে আক্রমণ এবং এক সময়ের সহযোগী দলকে ফ্যাসিস্টের দোসর বানিয়ে ফেলার চর্চা সামনে ভিন্ন কিছুর বার্তা দিচ্ছে।
কে না জানে, ২০২৪ সালের জুলাইতে এসে আন্দোলন দমনে কতো কঠোর হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কারফিউ জারি, দেখা মাত্র গুলির হুকুম কী বাদ ছিল? সেইসঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগই বিএনপি-জামায়াত, কোটাবিরোধী ছাত্রদের দমনে যথেষ্ট, এ ঘোষণা তো ছিলই। এক বছর আগের সেই বেদনা অনেকটা ভুলে যাওয়ার মানসিকতা লক্ষণীয়। কারো কারো বক্তব্য-বিবৃতিতে মনেই হয় না কোন পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে এমন অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশোর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয়। সেই নিদারুণ বাস্তবতায় প্রথাগত কিছু সংস্কার ও বন্দোবস্ত অবশ্যই কাম্য। রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের অভিপ্রায় সেখানেই। বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করা শান্তি ও গণতন্ত্রকামী সকলের পবিত্র দায়িত্ব। কিন্তু, সেখানে এখন মন-মননের বিভক্তি, কথার প্যাঁচ! আবার মাঝেমধ্যে সরকারও আক্রমণের শিকার। সরকারের ভেতর আরেকটি সরকারের অস্তিত্বও দেখছেন কেউ কেউ। কিছু নমুনাও বিদ্যমান।
তারওপর যোগ হয়েছে রাজনৈতিক চাঁদাবাজি। প্রায় প্রতিটি জেলায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি মহামারি আকার নিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে এসব ঘটনায় পতিত সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত। গণঅভ্যুত্থানের পর সেই দলটির নেতা-কর্মীরা হয় আত্মগোপনে, নয় কারাগারে। তাহলে এসব চাঁদাবাজি কে বা কারা ঘটাচ্ছে, এ প্রশ্ন যৌক্তিক। সব সরকারের আমলেই পেশাদার চাঁদাবাজরা যে কোমর বেধে নেমেছে, তাও সত্য। তা হলে মানে কী দাঁড়ালো? আগে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এসব রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায় থাকা চাঁদাবাজেরা রং বদল করে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়ে যেত। তাঁরা নিজেদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ভাবতে পছন্দ করত। এখন তো রাজনৈতিক সরকার নেই। ক্ষমতায় থাকা ইউনূস করকারের তো দল নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলটি এতটাই বিধ্বস্ত যে তাঁদের নেতা-কর্মীদের পক্ষে পোশাক বদল করে মাঠে থাকা অসম্ভব। নৌকার ঢোল বাজিয়ে, মুজিব কোর্ট গায়ে জড়িয়ে চাঁদা বখরার বাস্তবতা নেই। অবস্থা বুঝে তারা সওয়ার হয়েছে দেশের বড় দলটির ঘাড়ে। সেখানেও বহিষ্কারসহ নানা শাস্তি। এই কঠিনের মাঝেও পেশাদাররা দমছে না। কোনো না কোনো ডালপালা ধরছে।