জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ভারতীয় আধিপত্যবাদী চানক্য রাজনীতির ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখা। সেই এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের উপর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়েছিল। মূলত বাহাত্তর সাল থেকেই এ নিয়ন্ত্রণ ও আগ্রাসনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শেখ হাসিনার উপর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষাবিরোধী একটি ফ্যাসিবাদী ন্যারেটিভ চাপিয়ে দিয়ে গত দেড় যুগে বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয়-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে একটি অন্তহীন বিভেদ জারি রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ন্যারেটিভ ভেঙ্গে দিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভারতীয় শাসকরা তাদের পক্ষে একটি অনিবার্য পলিটিক্যাল সফ্ট পাওয়ার হিসেবে গণ্য করেছিল। বিগত সময়ে খোদ ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বাংলাদেশে ভারত সরকারের অতিমাত্রায় আওয়ামী নির্ভরতাকে ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা’র বিপদ সম্পর্কে মত দিতে দেখা গেছে। চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভিত্তি সমূলে ধসে পড়ে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে আওয়ামী লীগের লাখ লাখ কর্মী সমর্থক দিশাহারা কিংকর্তব্যকিমূঢ় হয়ে নিস্ক্রিয় অথবা আত্মগোপণে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করা হাজার হাজার নেতা-পাতিনেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। এহেন বাস্তবতায় ভারতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কৌশল ও নতুন স্টেকহোল্ডারের সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশেষত ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় আওয়ামী লীগের ভোট-ভা-ারে ভাগ বসাতে বিএনপি-জামায়াতের মত প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে অঘোষিত ও নীরব প্রতিযোগিতা ও কৌশল গ্রহণ করতে দেখা গেলে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু ভারতের কৌশল হচ্ছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিব্র বিরোধ, অবিশ্বাস-অনাস্থা ও সংঘাতের জন্ম দিয়ে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করা। জুলাই অভ্যুত্থানের তিনদিনের মধ্যেই পল্টনে সমাবেশ ডেকে বিএনপি ৩ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি তোলা ছিল অপরিনামদর্শিতা। এরপর ভারত এবং পলাতক আওয়ামী নেতারাও দ্রুত নির্বাচনের জিগির তুলতে শোনা গেছে। গত ১৫ বছরে দেশের পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী, বিজিবি, প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে আওয়ামী ধ্বজাধারি ক্যাডার বাহিনীতে পরিনত করা হয়েছিল। গত দেড় দশকের ধারাবাহিকতায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়ে রাজপথে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার এক চরম সন্ধিক্ষণে পুলিশ বাহিনী অগ্নিগর্ভ ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের কাছে পরাজিত হয়। আহত সিংহের মত হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের রোষানলে বেশ কিছু পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারিয়েছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন ধরে পুরো পুলিশ বাহিনীই নিস্ক্রিয় কিংবা লাপাত্তা হয়ে যায়। আধুনিক সমাজে পুরো দেশে পুলিশবিহীন একটি দিন কল্পনা করা যায়না। বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে হুকুম তামিল করা সদস্যরা পর্যন্ত আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে, নিয়ন্ত্রণহীন ও অস্থিতিশীল করে তুলতে ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্ডায় একের পর তুরুপের তাস বের হতে দেখা যায়। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে তাদেরকে ঢাকায় জড়ো করে আন্দোলনে নামানো, ইসকনের এক বহিষ্কৃত গুরুকে দিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করে তোলা, আনসার ভিডিপি সদস্যদের দিয়ে সচিবালয় দখলের চেষ্টা, বিভিন্ন এনজিও ও পেশাজীবীদের দাবি-দাওয়ার বহর দিয়ে রাস্তায় নামানো, সচিবালয়ে আগুন লাগানো ইত্যাদি বহুবিধ বহুমুখী কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি চলেছে ভারত সরকারের বাণিজ্য ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা, গদি মিডিয়ার অপপ্রচারসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা দখল করে নেয়াসহ সামরিক আগ্রাসনের হুমকি।
বাংলাদেশের একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বিশ্বনাগরিক আছেন। অভ্যুত্থান পরবর্তী কঠিন ক্রান্তিকালে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নিতে ছাত্র-জনতার অনুরোধে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস অর্šÍবর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ভারতের প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রনীতির বার্তা দিয়েছিলেন। তাঁর বার্তাটি ছিল, ভারত বাংলাদেশের সাথে সৎপ্রতিবেশিসুলভ ও সমতাভিত্তিক নীতি মেনে চলতে না পারলে, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করলে ভারতের সেভেন সিস্টার্সসহ পুরো অঞ্চলে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে প্রপাগান্ডা ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারের সুযোগসহ পরবর্তী কর্মকা- থেকে অদ্যাবধি ঘোষিত নীতি থেকে বোঝা যায়, ষড়যন্ত্র ও আধিপত্যবাদী নীতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের পথে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারি ও আগ্রাসী শক্তি সব সময়ই পরাজিত ও ব্যর্থ হতে বাধ্য। গত মাসে ইরানে ইসরাইলের মার্কিন সমর্থিত সামগ্রিক আগ্রাসনের প্রথম আঘাতেই বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ইরানি সামরিক কমান্ডার, পরমাণু বিজ্ঞানির মৃত্যুসহ নির্ভুল নিশানায় সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংসের পেছনে মোসাদের গুপ্তচর হিসেবে সে দেশের পতিত স্বৈরাচারি শাসক শাহের সমর্থক গোষ্ঠি এবং প্রবাসী কর্মী ও শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে থাকা ভারতীয়সহ বিদেশি নাগরিকদের ভূমিকার কথা জানা যায়। এরপর শত শত এসব মোসাদের গুপ্তচর, গোপন ড্রোন নির্মাণ কারখানাসহ নানা অবকাঠামো ইরানি বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ে। প্রথম আঘাতে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হলেও ১২ দিনের যুদ্ধে আমেরিকা ও ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতার পরও ইসরাইল ইরানের হাতে চরম সামরিক ও কৌশলগত পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়েছে। ইরানের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে আমাদের অনেক কিছুই শিক্ষণীয় আছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতার পাশাপাশি সুষ্ঠু ও সঠিক পররাষ্ট্রনীতি, জাতীয়তাবোধ ও সামরিক প্রস্তুতি থাকলে দেশি-বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। তিনদিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কথিত অপরাজেয় ফরাসি রাফায়েল যুদ্ধ বিমানও পাকিস্তানের জে-টেন সি যুদ্ধবিমানের কাছে মার খেয়ে পরাজিত হয়েছে। সঠিক নেতৃত্বের সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপে রাজনীতি ও যুদ্ধের সমীকরণ ও হিসাব-নিকাশ যে কোনো সময় পাল্টে যেতে পারে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরণের ভারসাম্যহীনতার মধ্য দিয়ে এক জটিল আবর্তে প্রবেশ করেছে। এ সময়ে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণে গত ৫৪ বছরের আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণ, অনৈক্য ও ব্যর্থতা দূর করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার যে অভাবনীয় সুযোগ এসেছে, তা থেকে রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে নিবৃত্ত রেখে হীন দলীয় স্বার্থে পরস্পর কাঁদা ছোড়াছুড়ি, হানাহানিতে ব্যস্ত রেখে জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিয়ে পুরনো বন্দোবস্তে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার ভারতীয় নীল নকশার ফাঁদে পা দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের মত রাজনৈতিক দলগুলো। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও নতুন রাজনৈতিক এজেন্ডা ও দৃষ্টান্ত গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের মধ্যে ব্র্যাকেটবন্দির বিষয় নয়। এটি যেকোনো দলের বৈষম্যনীতি ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের প্রতীক। দেশের মানুষ জুলাই সনদের রূপরেখায় গণতন্ত্র ও রাজনীতির একটি প্রাতিষ্ঠানিক নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আইনগত ভিত্তি নিশ্চিত করতে চায়। অর্ন্তবর্তী সরকার গঠণের আগেই কিংবা পরে কেন জুলাই সনদ গ্রহণ করা যায়নি, সে প্রসঙ্গে বলতে গেলে রাজনৈতিক বিতর্ক হতে পারে। সে প্রসঙ্গে না গিয়ে, এই জুলাই কিংবা ৫ আগষ্টের মধ্যেই জুলাই সনদ গ্রহণের যে জনআকাক্সক্ষা রয়েছে, তা থেকে দেশকে ভিন্ন এক অস্থিতিশীল বাস্তবতায় ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নির্বাচন কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের অবাধ চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হওয়ার পেছনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচ্ছন্ন আস্কারা বা পক্ষপাত জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপিকে এক ধরণের ইমেজ সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে পৈশাচিক কায়দায় যুবদল কর্মী সোহাগ হত্যা, খুলনায় বহিষ্কৃত যুবদল নেতাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যার ঘটনার যেসব মোটিফ বেরিয়ে আসছে, তাতে অনেকেই কোনো গোয়েন্দা সংস্থার গোপণ এজেন্ডার আলামত পাচ্ছে। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ রাখেনি তারা রাজপথে উগ্র শ্লোগানসহ মিছিল-সমাবেশও করেছে। বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত ছোট দলের উস্কানিমূলক ভূমিকার ফলাফল হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আলোকে জাতীয় ঐকমত্য ও জুলাই সনদ নিয়ে মতপাথর্ক্য বৃদ্ধির কারণে সময় ক্ষেপণ এবং তার ধারবাবাহিকতায় নির্বাচনে অনিশ্চয়তা ও জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট সৃষ্টির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার কদমবুসি করা রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বা হাসিনা ও তার দোসরদের প্রতি সিম্প্যাথিটিক, শত শত ওয়ান্টেড লুটেরা অপরাধিকে আশ্রয় দিয়ে গোপনে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগদানকারি সেনা প্রধান ওয়াকার উজ-জামানের প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ততা নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠ পর্যায়ে মোতায়েন করার পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতির পেছনে ডিজিএফআইয়ের গোপন এজেন্ডা রয়েছে কিনা সে প্রশ্নও উঠছে।
মিটফোর্ডের হত্যাকা-ের স্টান্ডার্ড ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সারাদেশে বিএনপি নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একইভাবে খুলনায় বহিষ্কৃত যুবদল নেতা মাহাবুব হত্যার পর অযাচিতভাবেই এর দায় জামায়াতের উপর চাপানোর অপপ্রয়াসও দেখা গেছে। বিএনপি ও জামায়াতকে পরিকল্পিতভাবে পরস্পরের বৈরী প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে কোনো পক্ষের গোপন এজেন্ডা কাজ করছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সিসি টিভি ফুটেজ দেখে মাহাবুবুর রহমান মোল্লা হত্যায় অংশগ্রহণকারি চক্রের কয়েকজনকে আটক করার পর ৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন স্থানীয়রা। এদেরকে বাম চরমপন্থী দলের নেতা হুমায়ুন কবির হুমার গ্রুপের লোক বলে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। একেকটি ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে রাজপথ পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে দেশে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী হতে দেখা যাচ্ছে। এক বছরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুনর্গঠন হয়নি। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী ও দোসরদের নীল নকশায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের পরিকল্পিত হত্যাকা-ের পর এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্লেইম গেইম, কাঁদা ছোড়াছুড়ির সুযোগে দেশে আরেকটা ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিয়ে, ট্রাইবুনালের বিচার কার্যক্রম স্থগিত করে ইনক্লুসিভ নির্বাচনের নামে কথিত রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের নামে ভারতের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতায় পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হলে তা হবে জুলাই শহীদদের রক্তের সাথে বড় ধরণের বিশ্বাসঘাতকতা। এ ধরণের পরিস্থিতি দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। দেশের মানুষ বৈষম্যহীন, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য হাজারো প্রাণের বিনিময়ে ভারতের পুতুল, গণহত্যাকারি সরকারকে তাড়িয়েছে। তারা এখন বিচারের সম্মুখীন। দলীয়ভাবে তারা কখনো অনুশোচনা প্রকাশ কিংবা ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। নাৎসিবাদ-ফ্যাসিবাদ মানে দল, সরকার ও রাষ্ট্র একাকার। গত ১৫ বছর হাসিনা ও তার দোসররা যে অপরাধ করেছে, তা হিটলার-মুসোলিনির চেয়েও অনেক বেশি। যুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানিতে সামরিক বাঙ্কারে হিটলারের আত্মহত্যা এবং ইটালিতে পার্টিজান প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে বেনিতো মুসোলিনি নিহত হওয়ার পর তাদের দোসরদেরও বিচার হয় এবং নাৎসি দল ও ফ্যাসিস্ট দল চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বারবার গণতন্ত্র হত্যা, গুপ্তহত্যা, গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ ও স্বাধীন জাতিসত্ত্বা ধ্বংসের জন্য দায়ী। ব্যক্তির চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে দেশ বড়। এ দেশের প্রত্যেক নিরপরাধ নাগরিকের স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং রাজনৈতিক দল করার অধিকার থাকলেও দেশ ও জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে বিদেশি শত্রুদের ক্রীড়নক, প্যাথলজিক্যাল কিলার-সাইকোফ্যান্টদের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। সঙ্গত কারণেই ভারতীয় এজেন্টরা এখন প্রবলভাবে সক্রিয় থাকবে। পতিত স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া দোসর আমলা, শেখ হাসিনার নিয়োগকৃত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা জুলাই অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। আরা যারা সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের মত অপরাধ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে বিচার ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করবে, ফৌজদারি অপরাধের বিচার শেষে তারা সহজেই রাজনীতির মূলধারায় যুক্ত হতে হয়তো বাঁধা থাকবে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, যত ষড়যন্ত্রই হোক, এ দেশের মানুষ ভারতীয় আধিপত্যের ফাঁদ আর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ন্যারেটিভে এন্টাগনিজমের রাজনীতি মেনে নেবে না। আমাদের জাতি রাষ্ট্রের লক্ষ্য পুরণ ও নিরাপত্তার স্বার্থবিরোধি যেকোনো শক্তিকে মোকাবেলা করেই জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। নিজ দলে থাকা বিভ্রান্ত ও ছদ্মবেশি শত্রুদের উস্কানিতে ভুল পথে পা বাড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই সকলকে সচেতন হতে হবে। ঊনবিংশ শতকের বৃটিশ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক বেনজামিন ডিজরেইলির ভাষায়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে রাজনীতির আর্ট অফ কম্প্রোমাইজ হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।