দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে রাজনৈতিক ইতিহাসের খারাপ ও অশুভ প্রবণতাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা যেন ইতিহাসের ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তির সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের দায় পূরণের কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রতিবেশি দেশের বর্ণবাদী শাসকদের রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে তারা নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ভেবে ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার চিরস্থায়ী আসনে বসিয়েছিল। ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা বাংলাদেশকে তাদের হেজিমনিক এজেন্ডার টেক্সটবুক এক্সাম্পলে পরিনত করেছিল। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিবেশি দেশের ভূখ- দখল ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের যেসব ঝুঁকি ও দায়-দায়িত্ব রয়েছে সেসব এড়িয়ে বাংলাদেশে শুধুমাত্র একটি বশংবদ শাসকগোষ্ঠির মাধ্যমে রাষ্ট্র দখল ও নিয়ন্ত্রণের এক অভূতপূর্ব মৌরসিপাট্টা বানিয়েছিল ভারত। এজন্য তারা প্রথমেই একটি সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকার বসিয়ে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে নিজেদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে একটি অর্ক্রেস্টেড ফেইক ইলেকশনের মাধ্যমে অভাবনীয় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে তাদের হাতে একটি প্রেসক্রিপ্টেড ফ্যাসিবাদী বয়ান ধরিয়ে দেয়া হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা ও মানুষের কাছে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও আস্থার প্রতিক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দেড়মাসের মাথায় পিলখানার দরবারে বিডিআর বিদ্রোহের নাটক সাজিয়ে দেশের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে চৌকষ ও দেশপ্রেমিক অফিসারদের হত্যা করে ভারতীয় আধিপত্যবাদের পথের কাঁটা দূর করা হয়। এ দেশের সেনাবাহিনী, সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী- বিডিআর, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী তৌহিদী জনতা এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ঐক্য যেকোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। আওয়ামী লীগে নেতা শেখ হাসিনার হাতে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক এজেন্ডা ধরিয়ে দিয়ে একে একে এসব শক্তিকে পরস্পকের থেকে বিচ্ছিন্ন, দুর্বল ও নির্মূল করার সব আয়োজন সুচারুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছিল। বিডিআর বিদ্রোহের নামে অর্ধশতাধিক সেনা অফিসার হত্যা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিএনপি-জামায়াতের মেধাবী নেতাদের জুডিসিয়াল কিলিংয়ের শিকারে পরিনত করা, জঙ্গিবাদের নাটক সাজিয়ে দেশের আলেম-ওলামাদের উপর জুলুম-নিপীড়ন, ক্রসফায়ার, আয়নাঘর ও শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের অন্ধকারে ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে তৌহিদী জনতার চেতনাকে স্তব্ধ করে দেয়ার ফর্মূলা ছিল মূলত ভারতীয় হেজিমনিক এজেন্ডার অংশ। পিলখানায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সময় ভারতীয় গোপণ বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি, অ্যামুনিশন ও অস্ত্রশস্ত্রের আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে। শহীদ সেনা অফিসারদের পরিবারের সদস্যরা বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের পোশাক পরা হিন্দি ভাষায় কথাবলা লোকদের উপস্থিতির কথা বলেছেন। একইভাবে শাপলাচত্ত্বরে ম্যাসাকারের ঘটনার সময় এবং জুলাই অভ্যুত্থানের আগেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরা হিন্দিভাষী হন্তারকের উপস্থিতির কথা কেউ কেউ সাক্ষ্য দিয়েছেন। ভুয়া পরিচয় ও আইডি কার্ড বানিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের পুলিশের চাকরি নেয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর হাজার হাজার পুুলিশ সদস্য পালিয়ে যাওয়ার পর অনেকেই আর ফিরে আসেনি। তারা ভারতীয় নাগরিক ছিল কিনা তা নিয়ে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান হয়নি। তবে তাদের নিয়ে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা গুজব ও প্রপাগান্ডার তুবড়ি ছুটিয়েছিল। তারা বলেছিল, ছাত্র-জনতা নাকি হাজার হাজার পুলিশকে পিটিয়ে মেরেছে! উপমহাদেশের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সবচেয়ে অবধারিত ও বিস্ময়কর ঘটনা। ভৌগলিক ও সাম্প্রদায়িক কারণে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও বৃটিশ শাসকদের যোগসাজসে শত বছরের বঞ্চনার কারণে পিছিয়ে পড়া পূর্ববাংলা থেকে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের নিমিত্তে ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশ গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল বৃটিশ সরকার। কলকাতার জমিদার ও হোয়াটকলার দাদাবাবুরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থহানির আশঙ্কা করে একে বঙ্গভঙ্গ আখ্যায়িত করে এক অভ’তপূর্ব গণআন্দোলন শুরু করে। ৫ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের পর ১৯০১১ সালে বৃটিশ সরকার ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ বিলুপ্ত ঘোষণা তথা বঙ্গভঙ্গ রদ করার পর কলকাতার বাবুরা শান্ত হয়। পূর্ববাংলার মুসলমান স্বপ্নভঙ্গ ও অনেক বড় ক্ষতির সামন্য পুষিয়ে দিতে ঢাকার নবাবদের দাবির প্রেক্ষিতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল বৃটিশ ভারতের সরকার। সে ঘোষণা বানচাল করতেও কলকাতার বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা এবং কবি-সাহিত্যিকরা বার বার স্মারক লিপি দিয়েছিল। পূর্ব বাংলায় জমিদারি থেকে প্রাপ্ত অর্থে পারিবারিক জৌলুস টিকিয়ে রাখলেও পূর্ব বাংলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের অর্ধশত বছর পর আসামসহ পূর্ববাংলা নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ গঠন, মুসলমানদের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগে মুসলিম লীগ দল গঠন, অত:পর হিন্দুদের প্রবল আন্দোলনের মুখে নতুন প্রদেশের স্বপ্ন ভেস্তে দিয়ে কলকাতার গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে এক নতুন বঞ্চনাবোধের জন্ম হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর নতুন বিশ্ববাস্তবতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পূর্ববাংলার নব্য শিক্ষিত তরুণরা কর্মসংস্থানের জন্য কলকাতায় সেটেল্ড হতে বাধ্য হয়। তিরিশের দশকের মধ্যভাগে ভারত শাসন আইনের মূল স্পিরিট ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন। সে আইনের আওতায় কলকাতায় মুসলমাদের নেতৃত্ব ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকায় দাদা বাবুরা প্রমাদ গুনতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা এবং ভারতে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে স্বাধীনতা যখন অবধারিত হয়ে উঠেছে, তখন কলকাতার বাবু বুদ্ধিজীবী ও নেতারা ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগকে অনিবার্য বলে দাবি তুলেছিলেন। মাত্র চার দশক আগে যারা ‘বঙ্গমায়ের অঙ্গচ্ছেদের’ বেদনায় অশ্রুসম্পাত করে গড়ের মাঠের বালি ভিজিয়েছিলেন, তারাই এখন দাবি তুলেন, বঙ্গভাগ করতেই হবে। তাদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কারণেই এক অদ্ভুত সীমারেখার মানচিত্র নিয়ে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে ওঠে, যা পাকিস্তানের নতুন সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের তকমা লাভ করে। কাশ্মির ও হায়দারাবাদের মত মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুসিত স্টেটগুলোকে সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করে নিলেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মাঝখানে বাংলাদেশকে শত্রু রাষ্ট্র স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ হিসেবে মেনে নেয়া ভারতের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এ জন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল ভারতের ডিপস্টেট। কালিদাস বৈদ্য, চিত্তরঞ্জন সুতারদের লেখায় সেসব ষড়যন্ত্রের ইতিহাস আংশিক উঠে এসেছে। আসামসহ অবিভক্ত বাংলা এ উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার সর্বময় সম্ভাবনা ছিল। বাঙালি হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি এবং মুসলিম বিদ্বেষের কারণে তা সম্ভব হয়নি। নিজেদের স্বার্থে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে এদেশকে তারা কিছুদিন একটি ভ্যাসাল স্টেট বা করদ রাজ্য হিসেবে টিকিয়ে রেখে একসময় জম্মু-কাশ্মিরের হরিসিং ও সিকিমের লেন্দুপ দর্জির মত পুতুল শাসক বসিয়ে দখল করে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। লুন্ঠন, নিপীড়ন, অস্থিতিশীলতা ও দু:শাসন চাপিয়ে দেউলিয়া করে এ দেশের সব প্রতিরোধ শক্তি নির্মূল করে ভারতীয় হেজিমনি চিরস্থায়ী করার বশংবদ পুতুল হিসেবে শেখ হাসিনার চেয়ে মোক্ষম, বিশ্বস্ত ও অতুলনীয় অতীতে আর কেউ ছিল না, ভবিষ্যতেও আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। সাত দশকের বেশি সময় ধরে আধিপত্যবাদী নীতির মাধ্যমে ভারত কোনো প্রতিবেশি রাষ্ট্রের আস্থাশীল বন্ধু হতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণে ভারতের আভ্যন্তরীণ জাতীয় সংহতিও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম ও জেনোসাইড ওয়াচের মত থিঙ্কট্যাংক ভারতকে মুসলমানদের বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ও ধারাবাহিকভাবে গণহত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক এজেন্ডায় ভারতের সব মুসলমানের ধর্মীয় আত্মপরিচয় মুছে দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করা এবং পৌরাণিক মহাভারত বা অখ- ভারতের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব প্রতিবেশি রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য ও দখলবাজি কায়েমের নীলনকশা পুরো উপমহাদেশকে অস্থিতিশীল ও অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে। কাশ্মির কখনোই ভারতের অংশ ছিল না। মোঘল ও বৃটিশরা কাশ্মিরকে প্রিন্সলি স্টেটের মর্যাদায় স্বাধীনতা স্বীকার করেছে। বাংলার বারো ভূঁইয়ারাও দিল্লির বশ্যতা মেনে নেয়নি। বাংলা, কাশ্মির, পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণের কথা থাকলেও মাউন্ট বেটেন ও সিরিল র‌্যাডক্লিফরা দেশভাগের মানচিত্র আঁকতে গিয়ে অবচেতনে পুরনো ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিকেই গ্রহণ করেছিলেন। এসব অহেতুক বিভক্তি ও ভেদনীতি না থাকলে এ উপমহাদেশ ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা কোরীয় উপদ্বীপের মতই সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে আবির্ভূত হতো। প্রতিবেশিদের পদানত রাখতে গিয়ে ভারত বারবার চীন-পাকিস্তানের কাছে মার খাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য কেউ মেনে নিচ্ছে না। মোঘলদের মত উদার, সহনশীল ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পথ অনুসরণ করতে পারলে, প্রতিবেশিদের সাথে আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে চীন-ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সমঝোতায় ৩শ’ কোটি মানুষের জনপদ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিনত হতে পারতো। প্রায় বিনাযুদ্ধে ভারত স্বাধীনতা লাভ করলেও লাখো মানুষের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। পুরনো ভেদনীতির আওতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সামরিক সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ালেও গত ৫৪ বছরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ভারতীয় হেজিমনি। কঠিন সময় নাকি শক্তিশালী মানুষের জন্ম দেয়। শেখ হাসিনার বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী রিজিম বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের পুতুল স্বৈরাচারি রিজিমকে পরাজিত করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার পেছনে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তি সেই অভিজ্ঞতা ও প্রত্যয় থেকেই উৎসারিত। এখন ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির কুশীলবরা সেই ঐক্য বিনষ্টের মাধ্যমে জাতিকে পুরনো বন্দোবস্তে ফিরিয়ে নিতে চাইছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে একের পর এক নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে অর্ন্তবর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে বাংলাদেশকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং এস্টাবলিশমেন্টের সব অপপ্রয়াস ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হলেও এখন তারা পতিত স্বৈরাচারের বর্ণচোরা দোসরদের কাজে লাগিয়ে আরো সুগভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। এখানে অর্ন্তবর্তী সরকারের ভেতরে থাকা বর্ণচোরা ভারতীয় এজেন্ট, গত ১৬ বছরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের নীলনকশার সাথে নতুন ও পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ভারতীয় ও বিদেশি এজেন্ট ও দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হানিট্রাপে ধরাখাওয়া ব্যক্তিরা সক্রিয় রয়েছে। অর্ন্তবর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে আগের সবগুলো প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পর গত কিছুদিন ধরে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটি উত্তপ্ত রেঁষারেষি ও বিভক্তির ফাঁদ তৈরী হতে দেখা গেছে। এসব দেখে অভিমানে কিংবা বিরক্ত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের হুমকি নিয়েও অনেক প্রপাগান্ডা ও গুজব ছড়াতে দেখা গেছে। এসব চলছে, চলবেই। আগামী নির্বাচনের আগে প্রত্যাশিত সংস্কার, গুম-খুন, গণহত্যা, লুটপাট ও রাষ্ট্র ধ্বংসের অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সম্ভাব্য আঞ্চলিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ মিমাংসার সন্ধিক্ষণে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, সেনাবাহিনী এবং অর্ন্তবর্তী সরকারের মধ্যে যে সমন্বয় ও সংহতি থাকা প্রয়োজন, তা বিনষ্ট করাই হচ্ছে ভারতীয় এজেন্টদের এখনকার এসাইনমেন্ট। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ভারতের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশকে এক নতুন ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনার দিগন্তে নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদে তা হয়তো সম্ভব নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে কাজ গত ৫৪ বছরেও করতে পারেনি, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অর্ন্তবর্তী সরকার এবার তা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের উপর ভারতীয় পানি আগ্রাসন, বাণিজ্য আগ্রাসন, কালচারাল হেজিমনি, সামরিক হুমকি, সীমান্ত নিরাপত্তা তথাকথিত বন্ধুত্বের নামে অধীনতামূলক মৈত্রী কিংবা দাম্পত্য সম্পর্কের মত সবকিছু উজাড় করে বিলিয়ে দেয়ার বিনিময়েও সমাধান করা যায়নি। ওরা বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য চায়না, গণতন্ত্র চায়না, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আত্মপরিচয় ও সম্পদের সুষম বন্টন চায়না। বিনাভোটে ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে গত ১৬ বছর শেখ হাসিনা ভারতের এসব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ জাতিকে বিভক্ত করে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, শেখ হাসিনার পতনের পর এক শ্রেণীর বিএনপি নেতাকে সেই একই ন্যারেটিভ আওড়াতে দেখা গেছে। একাত্তুরের শত্রুমিত্র আর চব্বিশের শত্রুমিত্র এক নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশ নিয়ে ভেবেছে, ওরা কিশোর বয়সে পিলখানায় আপনজন সেনা অফিসারদের মরতে দেখেছে, শাপলা চত্ত্বরে ধর্মপ্রাণ মানুষকে রক্তাক্ত-গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছে। একের পর এক বিনাভোটের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী রিজিম প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছে। তার চেয়েও অনেক ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন ও ব্যাংকিং সেক্টরসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার মাধ্যমে। ছাত্র-জনতা জীবন বাজি রেখে হাজার মানুষের জীবনের বিনিময়ে শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত না হলে শেখ হাসিনার অধীনে পরবর্তী ডামি নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীর ট্রেন চলাচল শুরু হতো। নিষিদ্ধ জামায়াত কিংবা বিএনপি নেতাদের কিছুই করার ছিল না। ভারতীয় হেজিমনি ও শেখ হাসিনার রেজিমের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বিএনপি-জামায়াত। জুলাই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারিও এ দুটি বড় রাজনৈতিক দল। শেখ হাসিনার পতন না হলে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হতো ২০২৯ সালের জানুয়ারিতে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ধরা হচ্ছে আগামি ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে। ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই ড. ইউনূস এই সময়কালের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দ্রুততম সময়ে যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন দিতে অর্ন্তবর্তী সরকারকে বাধ্য করতে কতিপয় বিএনপি নেতার বক্তব্য পতিত আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয়দের প্রত্যাশার সাথে মিলে যাওয়ার বাস্তবতাকে দেশের সাধারণ মানুষ ও বিএনপি’র তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সন্দেহের চোখে দেখছে। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি নেতারাই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারিদের প্রধান টার্গেট হবে, এটাই স্বাভাবিক। জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের ষড়যন্ত্র মোকাবেলার দায়ভারও বিএনপির উপরই বেশি বর্তায়। এ পথে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে আপোসের কোনো সুযোগ নেই।

[email protected]

সূত্র, ইনকিলাব