মনে পরিবর্তন এলে, প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সরকারি সম্পদের অডিট করে তার উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
১. ‘বাজেট’ শব্দটির বিশ্বজনীন ব্যবহার রয়েছে। অর্থাৎ বহু ভাষায় বাজেট শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষায় বাজেট শব্দের ব্যবহার দেখা না গেলেও দেশীয় পর্যায়ে বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন একটি সাধারণ রীতিতে রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন দেশে এর কাঠামো প্রমিত (স্ট্যান্ডার্ডাইজ) করার প্রয়াস থেকে অনুমেয় যে দেশের ঊর্ধ্বে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কোনো স্বার্থ মূল চালকের ভূমিকায় থেকে বার্ষিক বাজেট উৎসব নিশ্চিত করে।
২. ঘোষিত উদ্দেশ্যের নিরিখেই নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন সম্ভব, যদি না কেউ উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন। বাজেটকালে বহিঃস্বার্থের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা হতে দেখিনি। দেশীয় পর্যায়ে, বাজেট প্রণয়নকারী নীতিনির্ধারকরা অনেক সময়, একাধিক আড়ম্বরপূর্ণ স্লোগানে উদ্দেশ্যকে ব্যক্ত করেন। যেমন এবারকার বাজেট বক্তৃতার শিরোনামে একটি ‘ন্যায়সংগত ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা’র উদ্দেশ্যের উল্লেখ রয়েছে। মধ্যমেয়াদি নীতিকৌশলে, ‘জনগণকে স্বস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা’; ‘খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। সেসবের মাঝে আকস্মিকভাবে তিন শূন্য অর্জনের ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়েছে—শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নির্গমন। যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য গণ্য করাই শ্রেয়। বাজেট বক্তৃতার ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে গৎবাঁধা আরো কিছু লক্ষ্যের উল্লেখ রয়েছে এবং তৃতীয় অধ্যায়ে সুশাসনের নামে অনেকগুলো সংস্কারের উল্লেখ রয়েছে। এসব অসংগঠিত (এবং অসংলগ্ন বা বিক্ষিপ্ত) উদ্দেশ্য উল্লেখের কারণে নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যের নিরিখে বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণ দুরূহ।
৩. প্রথম ও দ্বিতীয় প্রস্তাব থেকে নিম্নোক্ত উপসংহার টানা যেতে পারে,
ক. যদি আন্তর্জাতিক পরিসরে অথবা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের কাছে একটি দেশের বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং স্বাধীন কোনো কৌশল অবলম্বনের সুযোগ না থাকে, তখন আন্তর্জাতিক চাওয়ার নিরিখে দেশীয় বাজেটের বিশ্লেষণ কাম্য।
খ. যদি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও একটি দেশের (সত্তার) কৌশলী (স্ট্র্যাটেজিক) হওয়ার সুযোগ থাকে, যা সেই দেশকে (সত্তাটিকে) অধিক সুফল দেবে, তখন আশা করা যায় যে সেই দেশ বহিঃস্বার্থ অনুধাবন করে নিজেদের স্বার্থ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে দরকষাকষির গণ্ডি চিহ্নিত করতে উদ্যোগী হবে।
লক্ষণীয় যে ভিন্ন ভিন্ন তাড়নায় চালিত একাধিক ক্রীড়ক কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বশ্যতাধর্মী অথবা কৌশলী খেলায় অবতীর্ণ হয়ে ভারসাম্যমূলক ফলাফলে উপনীত হতে পারে। এ চিন্তাধারায় মতবিনিময় আমাদের সমাজে অনুপস্থিত। অথচ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে, উন্নতমানের অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য কৌশলী হতে হলে, এ জাতীয় পূর্ব-ভাবনা জরুরি।
সংখ্যার বাইরে বাজেট নিয়ে ভাবনা
সম্পদপ্রাপ্তি সম্পর্কে নির্বিকার থেকে যারা অদৃশ্য শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ‘উদার’ হস্তে বণ্টনে লিপ্ত হন অথবা সেই বণ্টনের উদারতা বা মানবিক গুণাবলি যাদের বিশ্লেষণে প্রাধান্য পায়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান আলোচনায় গণ্য করা হয়নি। নিবন্ধের বাকি অংশে বাজেটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়ই উত্থাপিত কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
৪. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের নিরিখে বিচার করা সম্ভব না হলে সম্পদপ্রাপ্তি ও সম্পদ ব্যবহারের চাহিদার মধ্যকার ফারাক ধর্তব্যে এনে সরকারের আয়-ব্যয়ের কর্মপরিকল্পনা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এর বিশদ আলোচনায় না গিয়ে প্রাথমিক প্রেক্ষিতের বর্ণনা দেব।
উন্নয়ন অর্থনীতির সনাতনী তত্ত্বে (দ্বি-ফারাক তত্ত্ব, বা টু গ্যাপ থিওরি) দেশীয় অর্থ ঘাটতি মেটানোর জন্য বৈদেশিক ঋণের যৌক্তিকতা খোঁজা হতো। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় যদি পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারে, ফারাক (গ্যাপ) পূরণের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। বৃহৎ পরিসরের সম্পদ আহরণের (মোবিলাইজেশন) ভাবনা পরবর্তী সময়ে রাজস্ব সংগ্রহের পথ বেয়ে কর আদায়ে পর্যবসিত হয়। বাজেট ভাবনা মূলত শেষোক্ত দুটোকে ঘিরে প্রাথমিকভাবে সরকারি খাতকে নিয়ে।
সামষ্টিক অর্থনীতির দুটো অভিন্ন সম্পর্ক সরকারের আর্থিক সক্ষমতার পরিসীমা বেঁধে দেয়। প্রথমটি দেশীয় মুদ্রার ক্ষেত্রে, যে সমীকরণে, পরিচালন খরচ বাদ দিয়ে, প্রতি বছর, ব্যয়যোগ্য অর্থ = কর রাজস্ব + কর-বহির্ভূত রাজস্ব দেনা পরিশোধ + ব্যক্তি খাত ও ব্যাংক থেকে নেয়া কর্জ।
একইভাবে বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে, আগের ভাণ্ডার (রিজার্ভ) না ভাঙিয়ে এবং পরিচালন খরচ বাদ দিয়ে,
ভাণ্ডারে সংযোজন = নিট রেমিট্যান্স প্রাপ্তি + রফতানি আয় - আমদানি ব্যয় –বৈদেশিক দেনা পরিশোধ + বৈদেশিক ঋণ
প্রাথমিকভাবে ব্যক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (সরকারি) কোষাগারে জমা পড়লেও তার ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় মুদ্রায় সরকারের হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে তা কিনতে হয়। এই দুটো সমীকরণের মাঝে প্রণিধানযোগ্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ব্যাংকের কর্মকাণ্ডকে ধর্তব্যে আনতে হবে। ভিন্ন কোনো পরিসরে ব্যাংক কর্মকাণ্ডের বিশদ আলোচনা প্রয়োজন, যা উহ্য রাখা হলো।
কিন্তু একই মজুদ প্রবাহ (স্টক ফ্লো) সমীকরণ থেকে সর্বোত্তম (কাঙ্ক্ষিত) বৈদেশিক দেনার পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব। যদি বিদেশী বিনিয়োগ ও তার দায়সহ অন্যান্য প্রবাহের ওপর তথ্য থাকে এবং যদি সুদের হার ও বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্তির হারের কার্যকর সমীকরণ (functional equation) জানা থাকে। আমরা সে জাতীয় চর্চায় নিয়োজিত না হয়ে মহাজনি টোটকার নির্দেশানুযায়ী মোট জাতীয় উৎপাদনের (বা আয়ের) নির্দিষ্ট কোনো হারকে বিপদমুক্ত মনে করেছি অথবা দেনা পরিশোধের পরিমাণকে রফতানি ও রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের শতকরা হিসেবে গুনতিতে নিই। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান নীতি অনুসন্ধান করলে জানা যাবে যে ঝুঁকির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ঋণগ্রহীতার সক্ষমতা নির্ধারণে এ জাতীয় পরিমাপের আশ্রয় নেয়া হয়। অথচ একজন মহাজন বা ঋণ প্রদানকারীর (অথবা দায়বদ্ধতাহীন শাসকের) দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে আগ্রহী একজন ঋণগ্রহীতার দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করে, বাজেটে প্রতিফলিত বৈদেশিক ঋণসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের পর্যালোচনা করা উচিত।
৫. একটা সময় ছিল যখন বাজেটে বরাদ্দের কত অংশ ব্যবহৃত হলো এবং কেন (পাইপলাইনে থাকা) বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের মাত্রা কম, সেসবই ছিল গণমাধ্যম ও পেশাজীবী পর্যায়ের আলোচনায় মুখ্য বিষয়। আমার প্রয়োজন না হলেও ঋণ নিতে হবে কেন? অথবা আমি অপ্রয়োজনীয় খরচ করব কেন? মহাজনের বা টার্গেট অর্জনে ধাবিত ব্যাংক কর্মকর্তার তাগিদ থাকতে পারে। কিন্তু একই দৃষ্টিভঙ্গি কি ঋণগ্রহীতার হবে? একই ধ্যানধারণার প্রকাশ দেখা যায়, (শতকরা হারে) ‘এইড ইউটিলাইজেশন’ নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের অনেকে, ‘ঋণ’কে ‘দান’ (এইড) এবং ‘মহাজন’কে ‘দাতা’ আখ্যা দিয়ে ‘দেনাগ্রস্ত’ অবস্থাকে দীর্ঘায়িত করতে চাই! ‘ইউটিলাইজেশন’-এর ঘাটতিকে স্থানীয় অর্থনীতির অপর্যাপ্ত ধারণক্ষমতা (অ্যাবসর্পশন ক্যাপাসিটি) দিয়ে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হই। [‘শোষণ’-এর পরিবর্তে ‘ধারণ’ শব্দটি ব্যবহার করেছি]। জ্ঞানভাণ্ডারের এসব অতিপরিচিত শব্দ বা ধারণাগুলোর মাঝে যে ‘মহাজন’দের একপেশে স্বার্থ লুকিয়ে আছে, তা অনুধাবন জরুরি এবং একই বাস্তবতার ভিন্ন বয়ান তৈরি প্রয়োজন। বিকল্প জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে পেশাজীবী সংগঠনের ভূমিকা কাম্য।
৬. পরামর্শকদের টোটকার ফর্দে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও একটি পরিচিত আইটেম এবং কর-রাজস্ব বৃদ্ধিকে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণকে মুখ্য হাতিয়ার গণ্য করে আমরা বিশালাকারের কর আদায় প্রতিষ্ঠান লালন করি। অথচ কর-বহির্ভূত রাজস্ব আয়ের সম্ভাব্য পথগুলো আমাদের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয় না। লক্ষণীয় যে কর-রাজস্ব বৃদ্ধি সরকারি ভাণ্ডার স্ফীত করে এবং মোট সম্পদের ওপর নাগরিকের অধিগম্যতা (অর্থাৎ সম্পদপ্রাপ্তির সুযোগ) হ্রাস করে। তাই ভিন্ন আঙ্গিকে দেখলে কর আদায়ের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির পথ একটি দেশের সরকার ও সে দেশের নাগরিকদের বিরোধপূর্ণ অবস্থানে দাঁড় করায়। বহিঃশক্তির কাছে সে ধরনের বিরোধ অনেক সময়ই কাম্য। তদুপরি, যে রাষ্ট্রকাঠামোকে ‘ভর্তুকি’ দিয়ে দীর্ঘকাল লালন করা হয়েছে, তার অস্তিত্ব রক্ষার দায়ভার লাঘবের জন্য, সেই সব পৃষ্ঠপোষকের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ কর-বৃদ্ধির পরামর্শ আসা স্বাভাবিক। এ ধারার বিপরীতে কর-বহির্ভূত রাজস্ব বৃদ্ধি করলে, কর-রাজস্ব আদায়ের চাপ কমবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে জাতীয় উদ্যোগ সরকার ও নাগরিকের মাঝে নৈকট্য বৃদ্ধি করবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ বক্তব্যের পক্ষে নিম্নে কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে কর-বহির্ভূত রাজস্বের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; সরকারি খাতের উদ্যোগ থেকে লভ্যাংশ, সরকারি ঋণের সুদ, লাইসেন্সের মতো পরিষেবার জন্য ফি, জরিমানা ও প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে রয়্যালটি। মোট রাজস্বের প্রায় ১৫-১৭ শতাংশ এসব উৎস থেকে অর্জিত হয়। বাংলাদেশে এ সংখ্যা মাত্র ৭-৮ শতাংশ। যে রাজস্ব আসে ফি, লিজ, খাজনা এবং অন্যান্যের তালিকায় কিছু উৎস থেকে।
কর-বহির্ভূত রাজস্বকে মোটাদাগে আমি তিনভাগে দেখি: ক. সরকারি মালিকানাধীন ব্যবসা থেকে প্রাপ্তি, যেমন উদ্যোগ থেকে লভ্যাংশ অথবা সরকারি ঋণের/লগ্নি থেকে সুদ; খ. সরকারি সংস্থা কর্তৃক সেবা বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ, যার মাঝে নানাবিধ ফি-জরিমানা অন্তর্ভুক্ত এবং গ. সরকারি ও সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থার সম্পদ লিজ/ভাড়া বা বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ। একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে এ তিনটি ক্ষেত্রেই সেবা ও সম্পদের যে ‘বাজার দাম’ রয়েছে, তার বেশির ভাগই ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভোগ করছে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। সুবিধাভোগীদের মাঝে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতাধররা যেমন রয়েছে, তেমনি সাধারণ বিভাগীয় কর্মচারী ও নির্দিষ্ট খাতের বেসরকারি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীও রয়েছে। এসব অর্জনীয় (অর্জন-সম্ভব) কর-বহির্ভূত রাজস্ব সরকারি কোষাগারে না গিয়ে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিকে জিইয়ে রাখে এবং তা (আমার ধারণায়) সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বাধা। তাই আশ্চর্য হওয়ার নয় যে কর-বহির্ভূত রাজস্ব বৃদ্ধিতে ক্ষমতাবানদের এত অনীহা। অথচ উল্লেখিত খাতে রাজস্ব বৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় সাধারণ নাগরিক ও সরকারের মধ্যকার দূরত্ব কমানো সম্ভব, বিশেষত খ-এ উল্লেখিত সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে, স্বচ্ছভাবে বিক্রি করার মাধ্যমে।
মনে পরিবর্তন এলে, প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সরকারি সম্পদের অডিট করে তার উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা) পর্যায়ে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক মহাজনি সংস্থার উদ্যোগে সম্ভাব্য ছোটখাটো রাজস্ব উৎস চিহ্নিত করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে জাতীয় পর্যায়ে সেই উদ্যোগ অনুপস্থিত। আশা করব নবগঠিত রাজস্ব নীতি প্রণয়নকারী সংস্থা এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। রেলওয়ের জমির কথা জনৈক উপদেষ্টা উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু পরে আর কিছু জানা যায়নি। এ তালিকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও সেতু বিভাগের অধীন জমি যোগ হতে পারে। এছাড়া রাস্তাঘাট, রেলপথ, বন্দর, নদীপথ ও বিশেষায়িত অঞ্চল ব্যবহার থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা যাচাই করে তা বাজেট আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন ও বণ্টন চুক্তি এবং তা থেকে সরকারি ভাণ্ডারে নিট প্রাপ্তি আজও ধোঁয়াশায় রয়ে গেল! উল্লেখিত উৎসের কোনটির থেকে প্রাপ্তি ও খরচ আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের হিসেবের খাতায় থাকলে তা খাতওয়ারি কর-বহির্ভূত রাজস্বের তথ্যে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ রইল।
৭. কর যেমন রাজস্বের অংশ, তেমনি মোট রাজস্ব সামগ্রিক সম্পদ সংহতকরণের (অর্থাৎ রিসোর্স মোবিলাইজেশনের) অংশবিশেষ। রাজস্ব সংগ্রহ করে সরকার যেমন প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে পারে অথবা সম্পদ পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হতে পারে, তেমনি সমাজ ও অর্থনীতির সঞ্চয়কে বিনিয়োগে রূপান্তর করার পথগুলো মসৃণ করতে পারে। সরকারের মধ্যস্থতা ছাড়াই অনুকূল সরকারি নীতির ফলে সঞ্চয়কে যদি বিনিয়োগে রূপান্তর বা সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়, সরকারের দায়ভার যেমন লাঘব হবে, তেমনি ‘সরকারি ক্ষমতা’র অহেতুক কর্তৃত্ব থেকে নাগরিক জীবন মুক্তি পাবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের চরম ব্যর্থতা অনস্বীকার্য, যার কারণ অনুসন্ধান করতে চাইলে প্রথাগত ধারণা-সম্ভারের বাইরে যেয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার কাছে আমাদের দাসত্বের প্রকৃতি অনুধাবন হবে প্রথম পদক্ষেপ। এজন্য অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার এবং আগামী দিনের পেশাজীবী সংগঠন এ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখি।
সাজ্জাদ জহির: নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)
[২১ জুন ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অনুষ্ঠানে পঠিত নিবন্ধের অংশবিশেষ
সূত্র, বণিক বার্তা