বিগত দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনা যে ফ্যাসিস্ট হয়ে রাষ্ট্রকাঠামো ও গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন, তার মূল কারিগর ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। বিশ্বের ইতিহাসে খুব কম নজির রয়েছে, যেখানে প্রধান বিচারপতি ন্যায়নীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক রায় দিয়েছেন। খায়রুল হক তেমনই একজন বিচারক, যিনি বিচারকের আসনে বসে নিজের বিচারিক ন্যায়বোধ থেকে নয়, ক্ষমতাসীন দলের দিকে তাকিয়ে রায় দিয়েছেন। তার রায়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস তো হয়েছেই, শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। আইনজ্ঞরা বলে থাকেন, খায়রুল হক রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ করেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সকলেরই প্রশ্ন ছিল, ফ্যাসিজমের পথ তৈরি করে দেয়া খায়রুল হক কোথায়? তাকে ধরা হচ্ছে না কেন? অবশেষে এক বছরের মাথায় তাকে গত বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ি এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত আবদুল কাইয়ুম হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় এবং ওইদিন রাত সোয়া ৮টায় সিএমএম আদালতে হাজির করলে আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। উল্লেখ্য, এ মামলার বাইরেও তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
এবিএম খায়রুল হক গ্রেফতার হওয়ায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার গ্রেফতারে অনেকে আনন্দ প্রকাশ করেছে। গণতন্ত্রকামী মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার গ্রেফতার এবং যথাযথ বিচার চাচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বস্তি প্রকাশ করে বলেছেন, দেরিতে হলেও খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই, বাংলাদেশের একজন বড় শত্রু, যিনি বাংলাদেশের বিশাল ক্ষতি করেছেন। প্রধান বিচারপতির পদে থেকে তিনি রাষ্ট্র ও জনগণের সাথে প্রতারণা করেছেন। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আইনজীবীদের অনেকে বলেছেন, খায়রুল হক হাসিনার ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি বিচার বিভাগ ধ্বংস করেছেন। দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্রকামী সকলেই খায়রুল হকের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বিচারের মাধ্যমে তার যথপোযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন সচেতন মানুষও জানে, তিনি কীভাবে তার বিচারিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দেশকে ফ্যাসিজমের দিকে ঠেলে দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন। হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে কীভাবে সহায়তা করেছেন। এর ফলে দেড় দশক ধরে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা নিহত এবং চিরতরে অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে গেছে। তার রায়ের কারণেই দেশে বিচারহীনতা ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকা- জাতির ওপর চেপে বসেছিল। বিরোধীদলের শত শত নেতাকর্মী গুম, খুন, লাখ লাখ মামলা, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। এর মূল উৎস ছিল, খায়রুল হকের একের পর এক গণতন্ত্র বিধ্বংসী রায়। এসব রায় দেয়ার ক্ষেত্রে তার ন্যূনতম বিবেকবোধ কাজ করেনি। ২০১১ সালের ১০ মে তিনি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত রায় দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আগামী দুটি নির্বাচন এ সরকারের অধীনে হতে পারে বলে রায় দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর পূর্নাঙ্গ রায় লিখে তা থেকে পরবর্তী দুটি নির্বাচন হতে পারে অংশটি বাদ দিয়ে প্রকাশ করেন। সে সময় আইনজ্ঞরা এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। অবসরে যাওয়ার দীর্ঘসময় পর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা এবং রায় পরিবর্তন করা আইনসম্মত ছিল না বলে তারা মত দেন। তবে খায়রুল হক এসবের তোয়াক্কা করেননি। কতটা আওয়ামী ও হাসিনান্ধ হলে নিজের রায় নিজেই পরিবর্তন করতে পারেন! শুধু তাই নয়, তিনি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের নাম বাতিল, বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের আদেশ, বিতর্কিত বিচারপতিদের শপথ পড়ানোসহ আরও বেশ কয়েকটি গণতন্ত্র ও জনস্বার্থপরিপন্থী রায় দিয়েছেন। বিনিময়ে হাসিনার কাছ থেকে পেয়েছেন নানা সুযোগ-সুবিধা। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তিনি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা কাজে লাগিয়েছেন হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় রাখতে এবং ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে। তিনি তার বিবেকবোধকে হাসিনার কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে, তার নৈতিকবোধ কাজ করেনি। কাজ করেছে, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা, হাসিনার প্রতি অন্ধ আনুগত্য, আর বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি রাগ-বিরাগ ও প্রতিহিংসা। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তার রায়ে উজ্জীবিত হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের দাসী হয়ে দেশকে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। এই বিচারপতি এখন আদালতে বিচারকের বিচারের সম্মুখীন। জনগণের বিচারেরও সম্মুখীন।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে এবিএম খায়রুল হক দেশের বিচার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ ভরসাস্থল উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারের পাওয়ার পথ সংকুচিত করেছিলেন। তার দেয়া রায়গুলো রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী এবং দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়ার মূল উৎস ছিল। সাংবিধানিক পদে থেকে তিনি সংবিধান ও শপথ পরিপন্থী কাজ করেছেন। স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছেন। এ নিয়ে কখনোই তার কোনো বিকার ছিল না। বরং নিজের সুবিধা নেয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রের এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন, তার যথাযথ বিচার জনগণের প্রত্যাশামতো হবে বলে আমরা আশা করি। তিনি যেসব অন্যায্য রায় দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে আমলে নিয়ে তার বিচার করে ন্যায়বিচারকে আরও দৃঢ় করতে হবে। তার প্রতি কোনো ধরনের অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই।