বিশ্বজুড়ে দিন দিন এআইয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলতে গেলে বর্তমান প্রযুক্তির যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নাম। লেখালেখি, ডিজাইন, গবেষণা এমনকি ভিডিও নির্মাণসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এআইয়ের নানামুখী ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। একদিকে যেমন এই প্রযুক্তি কাজের গতি বৃদ্ধি এবং সময় সাশ্রয়ী করছে, অন্যদিকে এর অপব্যবহার সমাজে একধরনের আতঙ্ক ও বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওর পরিমাণ মারাত্মক হারে বেড়েছে। ১০টি ভিডিওর মধ্যে চার থেকে পাঁচটি ভিডিও এমন, যা সম্পূর্ণরূপে এআই দিয়ে তৈরি। দিন যত যাচ্ছে এর পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অধিকাংশই ট্রেন্ডিং ইস্যু নিয়ে নির্মিত। কখনো দেখা যাচ্ছে কোনো মৃত ব্যক্তি কথাবার্তা বলছেন—কীভাবে তাঁকে মারা হয়েছে বা পরিবারকে নিয়ে আবেগময় কথা। আবার কখনোবা রাজনৈতিক ইস্যুকে এডিট করে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে থাকে।
দেশের শহর থেকে গ্রাম, প্রায় প্রতিটি এলাকায় সহজলভ্যতার কারণে যেমন সাধারণ মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের সংখ্যাটা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারের হারও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সবাই তো আর ডিজিটাল সচেতন বা প্রযুক্তির বিষয়ে দক্ষ না। গ্রামের মানুষের অনেকেই এখনো এআই কী, তা ঠিকঠাকভাবে বোঝে না? ফলে যখন তারা কোনো এআই দিয়ে তৈরি মিথ্যা বা আংশিক সত্য ভিডিও দেখে, তখন সেটিকে বাস্তব মনে করে।
একটি বাস্তব ঘটনা বলি, তাহলে বুঝতে পারবেন এর ভয়াবহতা কতটা গভীরে চলে যাচ্ছে। ৩০ আগস্ট, আমার এক বন্ধু ঢাকায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তার বাবা ইউটিউব ও ফেসবুকে কিছু ভিডিও দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলেন, ‘এই ঢাহা যাইবার কোনো দরকার নেই! দেহি ফেইসবুক আর ইউটিউবে কী সব ভিডিও আইতাছে। দেশের অবস্থা একদম খারাপ হইয়া গেছে, বড় হামলা হইব কইরা কইতাছে!’ এই ভয় একেবারে ভিত্তিহীন হলেও ভিডিওগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, তা দেখে তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। চিন্তা করে দেখুন, এসব ভিডিও কী পরিমাণ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
আমার ক্যাম্পাস থেকে গ্রামে এসে দেখি, এখানকার মানুষও এসব ভিডিও দেখে সত্যি মনে করছে। তারা এডিট করা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভিডিও দেখে ভোট দেওয়া, না-দেওয়া নিয়ে আলোচনা করে। এসব ভিডিও যে ব্যাপক হারে তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে, তা আগে থেকে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম। গ্রামের অনেক মানুষের সঙ্গেই আমার ফেসবুকে যুক্ত থাকার কারণে তাদের শেয়ার করা ভিডিও দেখে কিছুটা অনুমান করেছিলাম। পুলিশসহ সামরিক বাহিনী নিয়ে মিথ্যা ভিডিও, জুলাই আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ নিয়েও নানা ধরনের মিথ্যা ভিডিও তৈরি হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ ধরনের এআইনির্ভর বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট এখন একপ্রকার ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা—তা বুঝতে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে, কারণ মানুষের মধ্যে একধরনের আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। কে যে সত্য বলছে আর কে যে এআইয়ের তৈরি বক্তা, তা এখন অনেকের কাছে বোঝা কঠিন।
মনে হচ্ছে, আমরা এখন এক বিপজ্জনক সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল প্রযুক্তির উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন গণসচেতনতা। সরকারের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের জন্য কার্যক্রম চালানো, বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং এআই চিহ্নিত করার সহজ মাধ্যম চালু করা উচিত। এআই যদি মানুষের কল্যাণে ব্যবহার না হয়ে সমাজে আতঙ্ক, ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে, তাহলে সেটি শুধু একটি প্রযুক্তি নয় বরং একটি সামাজিক রোগে রূপ নেবে। আমাদের এখনই প্রয়োজন প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ব্যবহার, প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা এবং নীতিগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। না হলে খুব শিগগির এই ব্যাধি একটি মহামারিতে রূপ নিতে পারে। যার মূল্য দিতে হবে আমাদের সবাইকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়