যানজট, দূষণ, জীবনযাত্রার ব্যয়, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যঝুঁকি—কোনো বিবেচনাতেই ঢাকা বাসযোগ্য নগরী নয়। এসবের বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শহরের নাগরিকদের ওপর। গত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই রাজনৈতিক কারণে রাজধানী শহরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়নি। বরং নানা গোষ্ঠীকে নানা সুবিধা পাইয়ে দিতে গিয়ে ঢাকাকে তারা পরিণত করেছে কংক্রিটের আবর্জনায়। ঢাকাকে মৃত নগরীতে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারহীনতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউকের) দুর্নীতি ও ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা মূলত দায়ী।

গত বুধবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক সংলাপে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ঢাকাকে বাঁচাতে দুর্নীতি বন্ধ করা এবং বিকেন্দ্রীকরণের যে পরামর্শ দিয়েছেন, তার সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি। কেননা গত কয়েক দশকে ঢাকাকে এমন এক অতিকেন্দ্রীভূত নগরে পরিণত করা হয়েছে যে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিচার, চাকরি, সরকারি সেবা নিতে হলেও মানুষকে ঢাকায় আসতে হয়।

যেকোনো সমাজে নগরায়ণ অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষণ। কিন্তু সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে নগর না থাকাটা চূড়ান্তভাবে অবৈজ্ঞানিক। আমাদের রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা ক্ষমতাকে যেমন করে কেন্দ্রীভূত রাখতে চান, ঠিক সেভাবেই অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জন্য ঢাকার ওপরই তাঁরা ভর করতে চান। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে গেলে এই মানসিকতার পরিবর্তন ও বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।

‘ড্যাপ নিয়ে জটিলতা: টেকসই নগরায়ণ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে রাজনীতিবিদেরা ঢাকার যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো যথার্থ বলে মনে করি। ঢাকার এই হতশ্রী অবস্থার পেছনে বিশৃঙ্খলভাবে এর গড়ে ওঠাকে তাঁরা দায়ী করেছেন। আমলা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ চললেও সমাধানের কাজটি কেউ করেন না। তাঁরা বলেছেন, দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার বাইরে থাকলে অনেক ভালো প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর তাঁরা সেটা বেমালুম ভুলে যান। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে রাজনীতিবিদদের জোরালো রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে ২০২২ সালে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) গেজেট প্রকাশ করে রাজউক। কিন্তু শুরু থেকেই সংশোধন নিয়ে মতপার্থক্য থাকায় আটকে আছে ড্যাপের বাস্তবায়ন। রাজউকের এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানো ও বাসযোগ্যতাকে বাড়ানো। ড্যাপ যদি বাস্তবায়ন না করা হয়, তাহলে এর লক্ষ্য পূরণ হবে কীভাবে?

ড্যাপ নিয়ে আবাসন ব্যবসায়ী ও নগর–পরিকল্পনাবিদদের একাংশের প্রধান অভিযোগ হচ্ছে এটি বৈষম্যমূলক। কেননা, এলাকাভেদে ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (এফএআর) মান আলাদা করা হয়েছে। ফলে ঢাকার অনেক এলাকায় আবাসন নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় জমির মালিক ও ব্যবসায়ীরা আবাসন নির্মাণ আগ্রহ হারাচ্ছেন। ধানমন্ডি-গুলশানের মতো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় এফএআর বেশি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর যেসব এলাকায় বেশির ভাগ মানুষ বাস করেন, সেখানে এফএআর কম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটা পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত বলে মনে করি।

আমরা মনে করি, এই অভিযোগ আমলে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে ড্যাপ সংশোধন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজউকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, টাকা ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না। ফলে সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রাজউক গড়ে তোলা না গেলে ‘মৃত নগরী’ ঢাকায় প্রাণের সঞ্চার করার যেকোনো কথা, যেকোনো উদ্যোগই ব্যর্থ হতে বাধ্য।

সূত্র, প্রথম আলো