গত সোমবার আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা তুন্দু লিসুকে আদালতে হাজির করা হইয়াছে। আদালতের বাহিরে জড়ো হইয়া চিৎকার করিতে থাকে 'নো রিফর্ম, নো ইলেকশন'। তিনি তাহার সমর্থকদের উদ্দেশে হাত উঁচাইয়া বলিয়াছেন, 'ভয়ের কিছু নাই, আমরা সঠিক পথেই আছি'। তাহারা আদালতের উপর আস্থা রাখিতে পারিতেছেন না। শুধু তুন্দু লিসুকেই নয়, গ্রেফতার করা হইয়াছে শীর্ষ পর্যায়ের আরো কিছু নেতাকে। তবে তিনি ভয় না পাইলেও ভয় পাইতেছেন আফ্রিকার প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল। এই বিচারে আদালতে হাজির হইতে কেনিয়ার সাবেক বিচারমন্ত্রী ও কয়েক জন মানবাধিকার কর্মীকে তানজানিয়ায় অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয় নাই। ইহা ছাড়াও কেনিয়ার সাবেক প্রধান বিচারপতি ইউলি মুতুঙ্গাকে গ্রেফতার করা হইয়াছে তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে এয়ারপোর্ট হইতে। কেনিয়ার সাবেক আইনমন্ত্রী মার্থা করুয়া সাংবাদিকদের বলিয়াছেন, 'রাষ্ট্র ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ব্যবহৃত হইতে পারে না। যাহারা মতের সহিত মিলিবে না, তাহাদের বিরুদ্ধে তুমি ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারো না।' তুন্দুর বিরুদ্ধে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হইয়াছে, যাহা আমরা উন্নয়নশীল বিশ্বে হামেশাই দেখিতে পাই। এই সকল দেশে প্রয়োজন হইলেই দেশপ্রেমিক নেতাকেও দেশবিরোধী বানাইয়া অভিযোগ দায়ের করা হয় এবং আদালতগুলি তাহা আমলে লইয়া বিচার করিতে শক্ত হইয়া এজলাসে বসে।
এই যে রাজনৈতিক কারণে বিচার বিভাগের ব্যবহার, ইহাই যেন তৃতীয় বিশ্বের ভবিতব্য। ২০২১ সালে নতুন করিয়া বিচার শুরু হইয়াছে প্রায় চার দশক পূর্বে আফ্রিকার চে গুয়েভেরা বলিয়া পরিচিত বুরকিনা ফাসোর নেতা থমাস সাক্বারার হত্যাকাণ্ডের। ইহাতে ১৪ জনকে আসামি করা হইয়াছে; কিন্তু সংশয় সেইখানেও রহিয়াছে, বিচারকাজ কতটা স্বচ্ছ হইবে এবং তাহা রাজনৈতিক বিবেচনায় হইবে কি না। এই সকল দেশে লক্ষ করা যায়, এক বিচারপতি অথবা বিচারক প্যানেল সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিয়া, অথবা রাগ-ক্ষোভের বশবর্তী হইয়া কাহাকেও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করিয়া দেয়! আবার দেখা যায়, সর্বোচ্চ শাস্তি হইবার মতো সকল সাক্ষীপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কাউকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। উন্নয়নশীল দেশে প্রায়ই লক্ষ করা যায়, এক বিচারক অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করিতেছেন, আবার ক্ষমতার পটপরিবর্তন হইলে আরেক বিচারক আসিয়া বেকসুর খালাস করিয়া দিয়াছেন। কে জিজ্ঞাসা করিবে, অথবা কে বলিবে যে কোন বিচার সঠিক ছিল? যদি একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে শাস্তির নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহা হইলে তো সেই বিচারকেরও শাস্তির অধীনে আসা উচিত। আবার যদি দোষী কাউকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়, সেই ক্ষেত্রেও বিচারকের দায় থাকিয়া যায়।
এই সকল কারণে মানুষের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হয়, উন্নয়নশীল দেশে বিচারের প্রতি আস্থাহীনতা দেখা দেয়। উন্নয়নশীল দেশের এই জটিল অবস্থা লইয়া বহু গবেষণা রহিয়াছে উন্নত দেশসমূহে। তাহারা মনে করে, আর্থিক অসংগতি, রাষ্ট্রের দুর্বল অবকাঠামো, সামাজিক বৈষম্য, দরিদ্রতা, দুর্নীতিগ্রস্ততা এবং আইনের জটিলতা ও অস্পষ্টতা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বিশ্বব্যাংক মনে করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য। ইহা সকল দেশকে মনে রাখিতে হইবে, যেই দেশে বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা থাকে না, সেই দেশে কোনো অর্গান সঠিকভাবে কাজ করিতে পারে না। তাই উন্নয়নশীল দেশসমূহের এই দুর্বলতা কাটাইয়া উঠা অপরিহার্য।