ফিলিস্তিনের গাজায় চলছে শতাব্দীর ভয়াবহতম নৃশংসতা। ইসরাইলের এই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে বিশ্ববাসী স্তম্ভিত। বিশিষ্টজনরা এই যুদ্ধ বন্ধ এবং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার নানা পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাদের অন্যতম। ট্রাম্প বলেছেন, আমি মধ্যপ্রাচ্যে ৩,০০০ বছরের পুরনো সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারব। ইসরাইল-গাজা যুদ্ধের সমাধানের মাধ্যমে এই শান্তি আনা সম্ভব। তিনি গাজায় ‘দ্য বোর্ড অব পিস’ নামে একটি অন্তর্বর্তী সরকার বা প্রশাসন গড়ে তোলা এবং তার প্রধান নিজেই হওয়ার কথা বলেছেন ট্রাম্প। কিন্তু ট্রাম্পের ২০ দফা সম্বলিত শান্তি পরিকল্পনা ছলনাময়ী এবং ইসরাইলঘেঁষা বলে ফিলিস্তিনের হামাসসহ সব পক্ষ এবং বিশ্ববাসী তা প্রত্যাখান করেছে। অবশ্য ইসরাইল সমর্থন করেছে।
যা’হোক, গাজায় চরম নৃশংসতায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে বিশ্বের সর্বত্রই। তবুও শতাব্দীর ভয়াবহতম নৃশংসতা বন্ধ করছে না স্মরণকালের ঘৃণ্য নরহন্তারক ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তার নির্দেশে সামরিক অভিযান চলছে এবং তাতে ফিলিস্তিনের গাজার বাড়িঘর ও স্থাপনাসহ সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। উপরন্তু বহু নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবুও ইসরাইলের নৃশংসতা বন্ধ হয়নি। দেশটি এখন অনাহারক্লিষ্ট গাজাবাসীর জন্য প্রেরিত খাদ্যের যান ও বিভিন্ন সামগ্রী এবং ত্রাণকর্মীদের আটক করছে। তন্মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে, ৪০টির বেশি জাহাজের নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা, যাতে ৫০০ অংশগ্রহণকারী রয়েছেন (তাদের মধ্যে বহুল আলোচিত এবং বিশ্বখ্যাত শিশু অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও রয়েছেন)। আটক ব্যাক্তিরা কারাগারে অনশন পালন করেছেন।
গাজায় চরম পৈশাচিকতায় সার্বিক সহায়তা করছে বৈশ্বিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সোল এজেন্টধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সার্বিক সহায়তায় ইসরাইল সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সম্প্রতি একই দিনে ৬টি মুসলিম দেশে আক্রমণ চালিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। উপরন্তু জাতিসংঘের সব ধরনের নির্দেশ লঙ্ঘন করে চলেছে বহুকাল থেকে! দেশটির বিরোধিতার কারণেই বিশ্ববাসীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ফিলিস্তিনের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। সমগ্র এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর রয়েছে ইসরাইল। এর জ্বলন্ত প্রমাণ গত ১২ আগস্ট ইসরাইলি সম্প্রচার বিভাগ i24NEWS-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি ‘বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক মিশন’ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। তিনি এ কাজে নিজেকে গভীরভাবে সংযুক্ত থাকার অনুভূতি বোধ করেন।
এই বৃহত্তর ইসরাইলের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল এবং জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও মিশরের কিছু অংশ। সে কারণে ইসরাইলও মাঝে মধ্যে আক্রান্ত হচ্ছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিরা প্রতিশোধ স্বরূপ এ আক্রমণ করছে। তাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তেলআবিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। প্রাণহানি ঘটছে অনেক। ইরানের সাথে কয়েকদিন ভয়াবহ যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। সে যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে ইসরাইলের ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়েছে। ফলে দেশটিতে এখন চরম আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ইসরাইল হিজবুল্লাহ এবং হুতিদের আক্রমণ এবং ইরানের সাথে যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সে দেশের বেশিরভাগ মানুষ চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। তারা প্রায় প্রতিদিনই নেতানিয়াহু বিরোধী প্রচন্ড বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। এছাড়া, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নেতানিয়াহুকে মানবাধিকার লংঘনকারী হিসাবে ঘোষণা করেছে। আইসিসি নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে। বিভিন্ন দেশ ইসরাইলের পণ্য বর্জন করেছে এবং কিছু দেশ সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ফলে ইসরাইল বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নেতানিয়াহু যে ভাষণ দিয়েছেন, তা বেশিরভাগ দেশ বর্জন করেছে। তিনি যখন ভাষণ দিতে শুরু করেন, তখন বাংলাদেশসহ ৭৭টি দেশের প্রতিনিধি অধিবেশন ত্যাগ করে চলে যান। ফলে সমগ্র অধিবেশন স্থল ফাঁকা হয়ে যায়, যা বিশ্বের সব মিডিয়ায় ফলাও করা প্রচারিত হয়েছে! নেতানিয়াহুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ ও বন্ধ না করার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বব্যাপী কঠোর সমালোচিত হচ্ছে। কিছু দেশ আমেরিকাবিরোধী শক্তির সাথে সম্পর্ক করছে। উপরন্তু আর্থিক, বাণিজ্যিক, সামরিকসহ বিভিন্ন চুক্তি করছে। ফলে বিশ্বে মার্কিনবলয় দুর্বল হয়ে পড়ছে আর প্রতিদ্বন্দ্বী বলয় শক্তিশালী হচ্ছে। তবুও ইসরাইলের প্রতি আমেরিকার অন্ধ প্রেমের পরিবর্তন হচ্ছে না!
যা’হোক, হুতি ও হিজবুল্লাহর আক্রমণকে সন্ত্রাসী কাজ বলে আখ্যায়িত করছে পশ্চিমারা। কিন্তু তারা ইসরাইলের সন্ত্রাসী ও আগ্রাসনমূলক কাজ বন্ধ করছে না। বরং বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। তারা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টীয় সন্ত্রাসকে জঙ্গীপনা বলছে না, তারা শুধুমাত্র মসুলিমদের সন্ত্রাসকে ইসলামী সন্ত্রাসী বা জঙ্গী বলে আখ্যায়িত করছে। তাতে প্রমাণিত হয় যে, পশ্চিমারা চরম ইসলামবিদ্বেষী। তাই তাদের কথা-বার্তায় কর্ণপাত করা দরকার নেই। তবে, এটা অনস্বীকার্য যে, মুসলমানদের শক্তি অর্জন করতে হবে। সে শক্তি শিক্ষায়, জ্ঞানবিজ্ঞানে, সামরিক ক্ষেত্রে তথা সর্বক্ষেত্রেই। তবেই মুসলিমদের ঐতিহ্য ফিরে আসবে। তখন সকলেই সমীহ করে চলবে। কেউ অবেহলা কিংবা শাসন শোষণ করার সাহস পাবে না। মুসলিমরা হবে পুনরায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। মুসলিমরা একদা বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী জাতি ছিল। তখন সকলে সমীহ করে চলতো। তখন বিশ্বের অর্ধেকেই বেশি অঞ্চল মুসলিমদের শাসনাধীনে ছিল। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, আর্থিক ও সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর নয়, এমন শক্তিশালী অমুসলিম দেশের সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে। তবে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ওআইসির সর্বশেষ দোহা সম্মেলনে ন্যাটো বাহিনীর ন্যায় আরব সেনা গঠন করার প্রবল দাবি উঠেছে। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র আরব দেশের সেনা দিয়েই গঠন ও কার্যকর হবে না, সে বাহিনী সমগ্র মুসলিম দেশ ও জাতিকে নিয়ে গঠন করতে হবে এবং সকলের জন্য কার্যকর করতে হবে।
ফিলিস্তিনের পূর্ণ স্বাধীনতা জরুরি। এটা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসন এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি হবে না। তাই পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আবশ্যক। ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজাকে পুনর্গঠন করে বাসোপযোগী করতে হবে অচিরেই। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও বিশ্বব্যাংকের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজা পুনর্গঠন করতে প্রয়োজন হবে ৫ হাজার কোটির বেশি মার্কিন ডলার। এ ক্ষেত্রে ওআইসিকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। দ্বিতীয়ত: ইসরাইলকে দমন করতে হবে। শুধুমাত্র পণ্য বর্জন করেই ক্ষান্ত হলে চলবে না, যেখানেই ইসরাইলের আগ্রাসন চলবে, সেখানেই সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।