গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। উভয় দেশই এই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছে। বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের দাসী হয়ে থাকা শেখ হাসিনা পাকিস্তানের সাথে শীতল সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। অথচ বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রেক্ষাপটে এখন আর ‘চির শত্রু’ বলে কিছু নেই, যদি না এক দেশ আরেক দেশের ওপর খবরদারি বা আধিপত্যবাদি আচরণ করে। পারস্পরিক স্বার্থে এক দেশ তার শত্রু দেশের সাথেও ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নেয়। এর সাম্প্রতিক নজির হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। যতই বিরোধ থাকুক না কেন, পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে তারা একে অপরকে ছাড় দিয়ে চলছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার চির প্রতিপক্ষ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে বৈঠক করেছেন। পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের ইন্ধনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পাকিস্তানের সাথে এক ধরনের বৈরি সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেননি। অন্তর্বর্তী সরকার ও পাকিস্তান সরকার পারস্পরিক স্বার্থে এই সম্পর্ক উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়ন জোরদার করার জন্য গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান। আজ আসছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এই সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, অন্য অনেক দেশের মতোই পাকিস্তানের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি, যেখানে ব্যবসা, বিনিয়োগের পাশাপাশি মানুষের চলাচল সুগম করার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। অতীতে অকারণে পাকিস্তানের সাথে বৈরি সম্পর্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এসেছি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যথার্থ বলেছেন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক যুদ্ধে নিজ স্বার্থে শত্রু দেশের সাথেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা ক্ষেত্রে পারস্পরিক বিনিময় থাকা শক্তিশালী কূটনীতির অংশ। পাকিস্তানের সাথে আমাদের অমিমাংসিত কিছু ইস্যু রয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, সেগুলো মিমাংসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উভয় দেশকেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে পাকিস্তানকে বেশি ছাড় দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা যদি বলি তাহলে বলতে হবে, পাকিস্তানকে ৭৫ ভাগ আর বাংলাদেশকে ২৫ ভাগ ছাড় দিতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের যে জায়গা দখল করেছে তা ইউক্রেনকে যেমন ছেড়ে দিতে হবে, একইভাবে রাশিয়াকেও ইউক্রেনের কিছু জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এভাবেই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পারস্পরিক এই ছাড়ের মানসিকতা পারস্পরিক স্বার্থে সবাইকে পোষণ করতে হবে। পাকিস্তানকেও এই ছাড় দেয়ার ইতিবাচকতা দেখাতে হবে। এতে কারো কোনো ক্ষতি নেই। বরং সম্পর্কের ভিত্তি দৃঢ় হবে এবং দুই দেশের পারস্পরিক বাণিজ্য-বিনিয়োগ, শিক্ষা, গবেষণা, আমদানি-রফতানির বিষয়গুলোর উন্নয়ন ঘটবে। পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বলেছেন, পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পণ্য রফতানি বাড়াতে একযোগে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান সিমেন্ট, চিনি, পাদুকা, চামড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভাল করছে। বাংলাদেশ চাইলে এসব পণ্য আমদানি করতে পারে। পাশাপাশি ওষুধ খাতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। এখাতে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে সহায়তা করতে পারে। পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করতে পারে। এছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্য আমদানিও বাড়াতে পারে। দুই দেশের কৃষি ও পাণ্য উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি ও মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি করা গেলে বৈশ্বিক খাতে বিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে দুই দেশের রফতানি সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। বাংলাদেশ পাকিস্তানে প্রধানত রফতানি করে পাট, টেক্সটাইল পণ্য, কাঁচা তামাক ও ওষুধ। অন্যদিকে, পাকিস্তান বাংলাদেশে রফতানি করে তুলা, বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্ট সুতা ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটলে আরও বহুমুখী আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করা যাবে। যুগের পর যুগ ধরে চলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ যে সাফল্য লাভ করেছে, এই অভিজ্ঞতা পাকিস্তানের কাছ থেকে নিতে পারে। সম্প্রতি পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বন্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে।

পাকিস্তানের সাথে ভারসাম্যমূলক সুসম্পর্ক সৃষ্টি হলে মধ্য এশিয়ায় বাংলাদেশের যোগাযোগ ও অর্থনীতির নতুন দ্বার খুলে যাবে। দেশগুলোর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, বিনিয়োগ, জনশক্তি রফতানি, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হবে। দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। এতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশই উপকৃত হবে। এজন্য দুই দেশকেই পারস্পরিক স্বর্থ সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হওয়া আবশ্যক। আমরা আশা করি, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে সুসম্পর্ক তৈরির যে সূচনা হয়েছে, তা দৃঢ় করতে উভয় দেশই আন্তরিকতার পরিচয় দেবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ প্রতিরোধে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সর্বদা সজাগ থাকবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

সূত্র, ইনাকিলাব