বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতের সিন্ডিকেট নতুন কিছু নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি খাতেই সিন্ডিকেটের অদৃশ্য হাত রয়েছে, যার ফলাফল আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করছি। কিন্তু সম্প্রতি শরীয়তপুরে ঘটে যাওয়া একটি নির্মম ঘটনা আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিল, এই দৌরাত্ম্য কতটা ভয়াবহ ও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করতে পারে।

শরীয়তপুরের এক ক্লিনিকে জন্ম নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এক নবজাতকের শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতা দেখা দেয়। চিকিৎসকেরা দ্রুত ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। পরিবারটি বিপদের মুহূর্তে কোনকিছু না ভেবে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে। তারা ঘুণাক্ষরেও জানতো না, একটু পরেই কী হতে যাচ্ছে। পরবর্তীতে এটিই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কিছুদূর যাওয়ার পরই সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়। দীর্ঘ বাকবিত-ার পরও তারা গাড়ি ছাড়তে রাজি হয়নি। ফলে নবজাতকটি অকালে প্রাণ হারায়। পৃথিবীতে আগমনের পর মুহূর্তেই যে জীবন তার পরিবারে আনন্দ বয়ে আনতে পারত, সেটি ধ্বংস হয়ে গেল কিছু নির্মম মানুষের লোভে ও অমানবিক আচরণের কারণে।

ঢাকা-শরীয়তপুরের দূরত্ব অনুযায়ী স্বাভাবিক ভাড়া নেওয়ার কথা থাকলেও সিন্ডিকেটভুক্ত অ্যাম্বুলেন্সগুলো জোর করে পরিস্থিতির বেড়াজালে ফেলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। প্রশ্ন জাগে, একটি জীবনের চেয়েও কি বেশি মূল্যবান সেই বাড়তি ভাড়া? অথচ, আমাদের সমাজ যেন ক্রমশ বিবেকবর্জিত হয়ে পড়ছে। শ্রম অধিকার নিয়ে আমরা সোচ্চার হই, অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। কিন্তু যখন এই অন্যায় আচরণের কারণে একটি নিরপরাধ প্রাণ ঝরে যায়, তখন আমরা কোথায় থাকি?

যে পরিবার তাদের সন্তান হারিয়েছে, সেই পিতা ১৮ বছর ধরে রাজধানীর মিরপুরে বিদ্যুৎ লাইন মেরামতের কাজ করেন। তিনি মামলা করতে রাজি হননি। কারণ, মামলার খরচ বহনের সামর্থ্য তার নেই, তাছাড়া মানসিক শক্তিও ফুরিয়ে গেছে। হয়তো নবজাতকের জন্য সযতেœ গুছিয়ে রাখা ছোট ভাঁজ করা জামাগুলো আর কখনো খোলা হবে না।

এটি কেবল এক পরিবারের করুণ কাহিনী নয়। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরের হাসপাতাল-কেন্দ্রিক অ্যাম্বুলেন্স চক্র একইভাবে সক্রিয়। সিন্ডিকেটভুক্ত না হলে অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্সে রোগী তোলা যায় না। ভাড়া দিতে হয় তাদের মনমতো। কারো প্রিয়জন মুমূর্ষ অবস্থায় থাকলেও এই সিন্ডিকেটের ফাঁদ এড়ানো কঠিন। ২০২১ সালের এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হাসপাতালের কর্মচারী, প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি ওয়ার্ড বয়রাও কমিশনের ভাগ পান। ভাড়ার ২০ শতাংশ পর্যন্ত চলে যায় তাদের হাতে। এ অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন নয়। আমার নিজের সঙ্গেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। কয়েক মাস আগে এক নিকট আত্মীয়ের অস্ত্রোপচারের জন্য নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের পাশে সার্জিক্যাল সামগ্রী কিনতে গিয়েছিলাম। একটি দোকান থেকে কিছু জিনিস নেওয়ার পর সেই দোকানে কিছু সামগ্রী না থাকায় আরেক দোকান থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করে। কারণ, আমি তাদের দোকান থেকে পুরো তালিকার জিনিসপত্র কিনিনি! অথচ, অপারেশন থিয়েটার থেকে জরুরি ভিত্তিতে সেই সামগ্রী আনার জন্য ডাক পড়েছে। নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্যও ছিল কেবল ওই কয়েকটি দোকানেই। সময়মত জিনিসগুলো না পৌঁছালে প্রিয়জনের মৃত্যু অবধারিত। তবে, এটি নিয়ে মানুষরূপী সেই পশুগুলোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। এরা করবে ব্যবসা, এরা করবে লাভ, এরা অপেক্ষায় থাকবে কারো করুণ পরিণতির মুহূর্তের জন্য; যখন ঝোপ বুঝে এরা কোপ মারবে। অসহায় রোগীর জীবন নিয়ে কেমন নির্দয় খেলা চলে, নিজ চোখে দেখা।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ইতোমধ্যেই অন্ধকারে নিমজ্জিত। তার ওপর জরুরি চিকিৎসা সেবা, পরিবহন ও ওষুধ সরবরাহকে কেন্দ্র করে এমন নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়া নিঃসন্দেহে ‘কফিনে শেষ পেরেক’ ঠুকে দেওয়ার শামিল। বছরের পর বছর সাধারণ মানুষ এই চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। অথচ, এখনো অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার কোনো তালিকা বা স্পষ্ট নীতিমালা নেই। মালিক-চালকের বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় হয়। সমস্যা মোকাবিলায় রাষ্ট্র প্রায়শই অসহায় হয়ে পড়ে, কারণ সামান্য পদক্ষেপ নিলেই শুরু হয় রাস্তা অবরোধ কিংবা ধর্মঘট। আর শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়। ভুক্তভোগী হয় সেই সাধারণ মানুষই।

তবে, এখনই সময় এসব সিন্ডিকেট চক্রকে নির্মূল করার। স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগঠন তৈরি করা দোষের নয়, কিন্তু তা দিয়ে মানুষকে জিম্মি করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে ন্যূনতম মানবিকতাও যদি হারিয়ে যায়, তবে উন্নয়ন কিংবা মানবাধিকারের সকল আলোচনাই অর্থহীন। যদি আমরা সত্যিই জীবন ও মর্যাদার কথা ভাবি, তাহলে অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, ক্লিনিক এমনকি হাসপাতালের বিছানার চারপাশে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেটগুলোকে মূল থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। কারণ, এটি কেবল সেবার প্রশ্ন নয়, এটি আমাদের বাঁচার প্রশ্ন। এটির সূচনা হতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট, স্বচ্ছ এবং দূরত্বভিত্তিক অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নির্ধারণের মাধ্যমে, যা একেবারেই কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। যারা এই নিয়ম লঙ্ঘন করবে, তাদের লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল করা হবে এবং যারা রোগীদের শোষণ করবে, তাদের স্থায়ীভাবে পরিবহন ব্যবসা পরিচালনা থেকে বিরত রাখতে হবে। তার পাশাপাশি, একটি জাতীয় হটলাইন চালু করতে হবে, যাতে পরিবারগুলো রিয়েল টাইমে অ্যাম্বুলেন্সের শোষণ বা লঙ্ঘনের অভিযোগ জানাতে পারে। একই সঙ্গে, রাষ্ট্রকে আরও সাশ্রয়ী মূল্যের অ্যাম্বুলেন্স সেবা সম্প্রসারণ করতে হবে, আরও যানবাহন ক্রয় করে, সব এলাকার কভারেজ নিশ্চিত করে এবং প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। অবশেষে, হাসপাতালগুলোর ওপর স্বাধীন তদারকি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আর কোনো সিন্ডিকেট জীবনের উপর দখল করতে না পারে। কারণ, যদি এই পদক্ষেপগুলো এখন নেওয়া না হয়, আরেকটি পরিবার তাদের সন্তানকে দাফন করবে, আরেকটি নবজাতক বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, আরেকটি জীবন লোভের কারণে ছিনিয়ে নেওয়া হবে।

এটি কোনও সুবিধার বিষয় নয়, এটি বাঁচার বিষয়। প্রতিটি বিলম্ব, প্রতিটি অতিরিক্ত ভাড়া, প্রতিটি সেবা প্রত্যাখ্যান; জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। যতক্ষণ এই সিন্ডিকেটগুলো নিকৃষ্টভাবে সক্রিয় থাকবে, সাধারণ মানুষকে তাদের সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্তে বন্দি হয়ে থাকতেই হবে।

সূত্র, ইনকিলাব