দেশজুড়ে মাদক যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তা কেবল সামাজিক অবক্ষয় নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও এক বড় হুমকি। কালের কণ্ঠে শনি ও রবিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গত ১৬ বছরে ১১ লাখের বেশি মামলা এবং ১৪ লাখের বেশি গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান থাকলেও মাদকের বিস্তার কমছে না, বরং বাড়ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সুদূরপ্রসারী এবং কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাসহ ২৬ ধরনের মাদক প্রায় অবাধে প্রবেশ করছে। জরুরি পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে অ্যাম্বুল্যান্স, বাস, ট্রেন ও নৌযানে মাদক আসছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো মাদক কারবারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ধারণা করা হয়, ৮০ শতাংশ পাচারকারীই রোহিঙ্গা।
ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, মাদক কারবারের শীর্ষ হোতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদেরও যোগসাজশ রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের মতো শহরে ২০টি মাদকের হাট এবং সাভার-আশুলিয়ায় হাজারের বেশি খুচরা ব্যবসায়ী ও তাদের বেতনভুক্ত বাহিনীর খবর প্রমাণ করে যে এই কারবার কতটা সুসংগঠিত। দুঃখজনক, পুলিশও বিভিন্ন স্থানে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, গ্রেপ্তারকৃত অপরাধীদের বড় অংশই জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও একই অপরাধে জড়াচ্ছে।
ষাটোর্ধ্ব শিপ্রা বেগমের মতো শীর্ষ মাদক সম্রাজ্ঞীর শতাধিকবার গ্রেপ্তার হওয়া ও জামিনে মুক্তি পাওয়া বিদ্যমান আইনের সীমাবদ্ধতা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতাকে স্পষ্ট করে।
জানা যায়, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্ডার দিয়ে তরুণ বাহকদের মাধ্যমে মাদক পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের হাতে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও এতে জড়িত। এই ডিজিটাল ও কৌশলী পদ্ধতি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় এই ব্যবসা পরিচালিত হয় বলে নিয়ন্ত্রণও কঠিন হয়ে পড়ে।
মাদক নির্মূলে এর আগে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেগুলো খুব একটা সফল হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশকে মাদকমুক্ত করার জরুরি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। কারণ গণ-অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে রয়েছে এবং তাদের কয়েকটি অভিযান ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। নওগাঁর মতো স্থানে তাদের ‘অ্যাকশন’ মাদক কারবারিদের উধাও করে দিয়েছে, যা প্রমাণ করে দৃঢ় পদক্ষেপের কার্যকারিতা। ফিলিপিন্স, মেক্সিকো ও ইরানের মতো দেশে সামরিক বাহিনী মাদক নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে।
অবশ্য মাদক নির্মূলে কেবল দমনই যথেষ্ট নয়, দরকার সামগ্রিক ও কার্যকর উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, এমনকি পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মীদের ওপর বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট চালু করা দরকার। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখা জরুরি। ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি এক বাস্তব চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবেলায় রাষ্ট্রের সব শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।