দেশে গত বৎসর একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হইয়াছে। তাহার পর হইতেই বিচার প্রার্থনার নামে একটি অবিচারের আশ্রয় গ্রহণ করিতেছে কিছু অবিবেচক মানুষ। বিশেষ করিয়া হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগে বেশির ভাগ এই ধরনের মামলা করা হইতেছে। দেখা যাইতেছে, যে যাহার নামে ইচ্ছা মামলা করিয়া দিতেছে। সকল মামলার আসামি যে নির্দোষ, তাহা আমরা বলিব না। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগিয়াছে, যাহাদের বিরুদ্ধে এই মামলা রুজু করা হইতেছে, তাহারা সকলেই কি এই ধরনের গুরুতর অপরাধে জড়িত?

এমন ঘটনা একটি নয় যে, দেখা গিয়াছে, মামলার বাদী চিনেন না আসামিকে। গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি, যিনি হাসপাতালে শয্যাশায়ী, অথবা অসুস্থতার কারণে কথা বলিতে কষ্ট হয়, তাহাদেরও মামলায় আসামি করা হইতেছে; ক্ষেত্রবিশেষে প্রধান আসামি! অধিকন্তু বাদী তাহার আর্জিতে 'আরো অনেকে' উল্লেখ করিয়া দেশের সাধারণ মানুষকেও ভালনারেবল করিয়া তুলিতেছে। এই আরো অনেকের প্রচলন আজ নতুন নহে, চিরাচরিত। ইহাতে পুলিশ যে কাহাকেও পাকড়াও করিয়া যে কোনো মামলায় ঢুকাইয়া দেওয়ার সুযোগ পাইয়া আসিতেছে। এইরূপ মামলার প্রকোপ দেখিয়া খোদ আইন উপদেষ্টা হতাশ হইয়াছেন। তিনি সম্প্রতি জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উপলক্ষ্যে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বলিয়াছেন, 'বাংলাদেশে আইনে কোথাও তো মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা দেওয়া নাই। যে যার মতো মামলা করছে।

এখানে অনেক হয়রানিমূলক, বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে। এগুলো অত্যন্ত আনফরচুনেট, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। মামলা করে ফেলার পর পুলিশ-আদালত প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করছি। মামলা হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, অভিযোগের কোনো বস্তুনিষ্ঠতা পাওয়া না গেলে কাউকে যেন গ্রেফতার না করা হয়।' তাহার বক্তব্যের আলোকেই আমরা অনুভব করিতে পারি, একটি মামলায় বিচারের সম্মুখীন হইয়া দোষী বা নির্দোষী যাহাই হউক, অভিযুক্তকে কতটা নাজেহাল হইতে হয়, কতটা কষ্টকর এবং দীর্ঘসূত্রিতায় আবদ্ধ হইয়া পড়িতে হয় তাহা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

শুধু আইন উপদেষ্টা বা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নহে, মামলা গ্রহণকারী থানার লোকেরা জানে, এলাকাবাসী জানে এই মামলাগুলির 'মেরিট' কী! এই ধরনের অসংখ্য মামলা যে দোষী ব্যক্তির পাশাপাশি অসংখ্য নির্দোষী মানুষকে ভোগাইতেছে, তাহা কাহারো বুঝিতে অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ভুয়া মামলারও শাস্তি রহিয়াছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারায় পরিষ্কার উল্লেখ রহিয়াছে, যদি কোনো ম্যাজিস্ট্রেট মামলা হইতে কোনো অভিযুক্তকে খালাস দেন এবং তাহার কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, অভিযোগটি মিথ্যা, তুচ্ছ বা হয়রানিমূলক ছিল, তাহা হইলে তিনি অভিযোগকারীর প্রতি ঐ নির্দোষ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।

অন্যদিকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২১১ ধারা কেহ যদি কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করে, তাহা হইলে তাহার দুই বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হইতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যাহারা এই ধরনের মামলা রুজু করিতেছে, তাহারা এই ধরনের আইনকানুনের খবরও রাখিতেছেন না। এমনিতেই বাংলাদেশের আদালতে লক্ষ লক্ষ মামলা অপেক্ষমাণ, অর্থাৎ মামলার বিচারিক কার্য চলমান, তাহার উপর এই ধরনেরও মামলা দেশের বিচার বিভাগের বোঝা বাড়াইয়া চলিয়াছে। এই ধরনের অবস্থার কারণেই বিচারকার্য বিলম্ব হইতে বাধ্য হয় এবং যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সে বলা উইলিয়াম এভার্ট গ্লাডস্টোনের সেই বিখ্যাত উক্তিই প্রকট হইয়া উঠে, জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনায়েড। সুতরাং দেশে এই উদ্বুদ্ধ বিড়ম্বনা হইতে জনগণ মুক্তি চাহে।

সূত্র, ইত্তেফাক