বাংলাদেশের সামনে সাশ্রয়ী খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার দরজা খুলে গেছে। এতদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বিদেশ বলতে ভারতে চিকিৎসা নিতেন। ভারত বলতে প্রধানত কলকাতা এবং চেন্নাইয়ের চিকিৎসা বোঝায়। যারা অ্যাফোর্ড করতে পারেন তারা দিল্লিতেও যেতেন। তবে বাংলাদেশ থেকে দিল্লিতে বিমানে যাওয়ার ডাইরেক্ট ফ্লাইট খুব কম। অনেককে কলকাতায় ট্রানজিট নিয়ে দিল্লিতে যেতে হয়। ফলে খরচ বেশি পড়ে। চেন্নাইতেও বিমানেই যেতে হয়। অনেকে চেন্নাই পছন্দ করেন। আর কলকাতা তো বাড়ির পাশে। যারা কিছুটা সচ্ছল তারা বিমানেই কলকাতা যান। আর মধ্যবিত্ত এবং নিম্মবিত্তেরা বাসে কলকাতা যান।বাংলাদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ড

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত এভাবেই চলছিলো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ভারত সরকার সব রকমের ভিসা বন্ধ করে দেয়। এমনকি মেডিকেল ভিসাও বন্ধ করে দেয়। তাই বলে তো আর চিকিৎসা বন্ধ থাকতে পারে না। আমাদের পাশেই আরেকটি দেশ। নাম থাইল্যান্ড। রাজধানী ব্যাংকক। ভারতে চিকিৎসা নেওয়া যখন মোটামুটি বন্ধ হলো তখন অনেকে ব্যাংককমুখী হলেন। ব্যাংককেও বিমানে যেতে হয়। ব্যাংককের চিকিৎসা খরচ ভারতের চেয়ে বেশি। তবে আমার ভাই এবং ভাগ্নী গত মাসে ব্যাংককে চিকিৎসার জন্য প্রায় ১৩ দিন ছিলো। ওদের কাছ থেকে ফাস্ট হ্যান্ড রিপোর্ট পেলাম। ওদের ডাক্তার কনসাল্টেশনের সময় অনেক ধৈর্য ধরে কথা শোনেন। রোগীদের একটি ধারণা আছে। তারা মনে করেন যে, বেশি করে সব কথা বলতে পারলে তার চিকিৎসা ভালো হবে। আর তা ছাড়া ডাক্তারের কাছে মন খুলে কথা বলতে পারলে রোগী ৪ ভাগের ১ ভাগ তখনই ভালো হয়ে যান। ওরাও টেস্ট দেন। তবে সেটি বেশ সময় নিয়ে। ওদের যন্ত্রপাতি নাকি ভারতের চেয়ে উন্নত। আমার যেসব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কথা বলছি, তারা এবং তাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা দিল্লি, চেন্নাই ও কলকাতার সব জায়গাতেই ট্রিটমেন্ট করিয়েছেন। ওদের মুখেই শুনতে পাই, ব্যাংকক চিকিৎসার ক্ষেত্রে আচার ব্যবহার, যন্ত্রপাতি, নার্সদের ব্যবহার সবকিছু ভারতের চেয়ে উন্নত।

আর একটি ডেস্টিনেশন আছে। সেটা হলো সিঙ্গাপুর। তবে সিঙ্গাপুর অত্যন্ত ব্যয়বহুল। চিকিৎসার মান স্টেট অব দি আর্ট। খরচের কারণে উচ্চবিত্তরা ছাড়া সেখানে কারো পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় না।

কথায় বলে, এক দরজা বন্ধ হলে আরো দরজা নাকি খুলে যায়। ভারত ভিসা বন্ধ করার পর মানুষের কাছে বিকল্প দরজা খুলে গেছে। লেখার প্রথমে যে বিকল্প দরজার কথা বলছিলাম এটি হলো সেটি। সেটি হলো গণচীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং। কুনমিংয়ে চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে এমন দু’ জনের কথা শুনলাম যারা সেখানে চিকিৎসা নিয়ে গতমাসের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরেছেন। এসম্পর্কেই আজ আপনাদের কাছে বলবো।

তবে তার আগে শনিবার ১৬ অগাস্ট এই লেখা শুরুর সময় চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের কিছু বক্তব্য এবং কিছু অনুযোগ পত্রিকায় দেখলাম। আসিফ নজরুলের অভিযোগ বা অনুযোগ যথার্থ বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। আসলে বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসা করার জন্য বিদেশে যায় কেনো? এটি একটি জেনুইন প্রশ্ন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর মোতাবেক উপদেষ্টা বলেছেন যে, মানুষ বিরক্ত ও নিরুপায় হয়ে চিকিৎসা নিতে বিদেশে যায়। সকলেই জানেন যে, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা ইন্ডিয়ায় বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা বাবদ বছরে আনুমানিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। ৫ বিলিয়ন ডলার চাট্টিখানি কথা নয়। ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ১৩ হাজার কোটি টাকা। তার মানে চিকিৎসা বাবদ বাংলাদেশ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যায়। ভেবে দেখুন তো, এই বিশাল অংক যদি বাংলাদেশে থাকতো তাহলে বেশি খরচ এবং সময়ের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতো। কিন্তু কেনো মানুষ বিদেশে যাচ্ছে?বাংলাদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ড

॥দুই॥

আসিফ নজরুল বলেন, এখানে ডাক্তাররা অনর্থক অনেক বেশি টেস্ট দেন। তিনি বলেছেন, এমন ডাক্তারও আছেন যারা অপ্রয়োজনে ১৪টি টেস্টও দিয়েছেন। ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ঐ পেসেন্ট টেস্ট না করে গ্রামে ফিরে গেছেন এবং সেখানকার ডাক্তারের কাছে কোনো টেস্ট ছাড়াই চিকিৎসা করে ভালো হয়েছেন।

আমার নিজের কথাই বলছি। এখানকার বড় বড় ৪/৫ জন ডাক্তারের কাছে আমাকে মাঝে মাঝে যেতে হয়। একে তো সিরিয়াল পাওয়া মুশকিল। তারপরেও কোনো সময় সিরিয়াল পড়ে ৩৫ বা ৪০ নাম্বারে। আমি নাম বলছি না। তবে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারি, ল্যাব এইডে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বিকেল ৫টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। রোগী তার অসুবিধা বলতেই থাকেন। কিন্তু তার কথা বলা শেষ হওয়ার অনেক আগেই ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছেন। এই ডাক্তার সাহেবসহ আরও দু’ তিন জন ডাক্তার রয়েছেন যারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ওষুধের নাম লিখে দেন এবং বলেন যে, অমুক মেডিকেল স্টোর থেকে এই ওষুধ পাওয়া যাবে।

ডাক্তারদের কনসাল্টেশন ফি? সেটি নিয়ে কি আর বলবো? ৪ বছর আগেও যে ডাক্তারকে ফি দিয়েছি ৪০০ টাকা এখন তাকে দিচ্ছি ২০০০ টাকা। তার অ্যাসিসট্যান্ট বললেন, শীঘ্রই ডাক্তার সাহেব নাকি তার কনসাল্টেশন ফি বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করবেন। আর সার্জারি? একটি বড় সার্জারির কথা বলি। সেটি হলো হিপ রিপ্লেসমেন্ট। হাঁটুরও রিপ্লেসমেন্ট হয়। ওরা বলেন, জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট। তিন বছর আগেও যেখানে জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট চার্জ ছিলো আড়াই থেকে ৩ লক্ষ টাকা সেখানে এখন সেটা ৫ লক্ষ টাকা। হাসপাতালে একবার ঢুকলে কম করে হলেও লাখ টাকার কমে আপনি বের হতে পারবেন না। আপনার ডায়াবেটিস চেক এক বার করলেই হয়। কিন্তু কম করে হলেও দিনে ৩ বার করা হবে। প্রতিবার ২০০ টাকা। দিনে শুধু এই খাতেই ৬০০ টাকা। এসব আপনারা সকলেই জানেন। এখন ফিরে যাচ্ছি কুনমিংয়ের চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি খবরে জনৈক জান্নাতুল নঈমের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তার মেরুদন্ডে প্রচন্ড ব্যাথা ছিলো। বাংলাদেশের মফস্বল থেকে শুরু করে ঢাকার বড় বড় ডাক্তারদেরকে তিনি দেখিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। অবশেষে একজনের পরামর্শে তিনি কুনমিংয়ের টং গ্রিন হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তার একটি সার্জারি হয়। অতঃপর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। মফস্বলের একটি শহরে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সন্মেলনে তিনি জানান যে, কুনমিংয়ের স্বাস্থ্য সেবা অসাধারণ। সেখানে পেসেন্টের (নঈমের) বিছানা পরিষ্কার করেছেন ডাক্তার সাহেব নিজে, তার ড্রেসিংও করেছেন। রাতে অন্তত ১০ বার নার্সরা এসে তার অবস্থা জেনেছেন এবং ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করেছেন।বাংলাদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ডভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট কিনুন

একদল বাংলাদেশি সাংবাদিককে কুনমিং হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো। ফিরে এসে তারা জানান যে, এই হাসপাতালের যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি এমন যে, সেটি সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারে এবং অপারেশন করতে পারে। ঐ হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেন লিং বলেন, আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্য আমরা এমন ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থা করেছি, যার ফলে রোগীদের নিরাপত্তা এবং টেস্টের মান যাতে উন্নত ও সঠিক হয় সেটি নিশ্চিত করেছি।

কুনমিং হাসপাতালে চোখের চিকিৎসা আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশের সাথে তুলনীয়। এখানকার লেজার সার্জারি পৃথিবীতে অনন্য দৃষ্টান্ত। চিকিৎসা শুরুর আগে এখানকার ডাক্তাররা রোগীকে বিশদভাবে বর্ণনা করেন যে, তার বর্তমান অবস্থা কেমন? এরপর ডাক্তার সাহেব কীভাবে কী করতে চান সেটি বর্ণনা করেন। রোগী যদি ডাক্তার সাহেবের বর্ণনার সাথে একমত হন একমাত্র তখনই তার চিকিৎসা শুরু হয়। আর একমত না হলে চিকিৎসা নেওয়া বা না নেওয়া রোগীর ইচ্ছা। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশিরা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য প্রথম কুনমিং যান। তারপর থেকে এপর্যন্ত ৬০০ রোগী কুনমিংয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আশা প্রকাশ করেছেন যে, সবে তো বাংলাদেশিরা আসতে শুরু করেছে। বছর শেষে এই সংখ্যা ৪ থেকে ৫ হাজারে দাঁড়াবে।

॥তিন॥

ঢাকা থেকে কুনমিং ২ ঘণ্টার ফ্লাইট। কুনমিংয়ে ২৯ হাজার ৬শত ৭৮টি মেডিকেল ইনস্টিটিউশন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৩ শত ১৯টি প্রথম শ্রেণীর হাসপাতাল, ১শত ২২টি অপেক্ষাকৃত কম উন্নত হাসপাতাল (টারসিয়ারি) এবং ৪৭২টি ২য় শ্রেণীর হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে রয়েছে মোট ৩ লক্ষ ৭০ হাজার বেড বা শয্যা।

ইউনান প্রদেশের হেলথ কমিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর ওয়াং জিয়াং কুন বলেন, বাংলাদেশের জন্য আমরা এমন কয়েকটি হাসপাতাল সিলেক্ট করেছি, যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসহ চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।

এবার খরচের প্রসঙ্গ। কুনমিংয়ে চিকিৎসা খরচ ব্যাংককের খরচের চেয়ে কম। আর কলকাতার চিকিৎসা ব্যায়ের সমান। কতগুলো চিকিৎসা ব্যয় অনেক কম। বাংলাদেশে ব্লাড সুগার টেস্ট করতে নেওয়া হয় ২০০ টাকা। কিন্তু কুনমিংয়ে ১০০ শত টাকা। হৃদরোগের চিকিৎসার বাংলাদেশে খরচ পড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। কিন্তু কুনমিং এবং চীনে এই খরচ সর্বোচ্চ ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। বাংলাদেশে কনসাল্টেশন ফি দেড় হাজার থেকে ২ হাজার টাকা। কুনমিংয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এখানকার খরচ ব্যাংকক তো বটেই, এমনকি মালয়েশিয়ার চেয়েও কম পড়ে।

তবে এখানে রয়েছে দুটি সমস্যা। প্রথমত ভিসা প্রসেসিং দীর্ঘ সময় নেয়। দ্বিতীয়ত ভাষা সমস্যা। চীনারা ইংরেজি ভাষা বোঝে না। সেক্ষেত্রে আপনাকে দোভাষীর সাহায্য নিতে হবে। প্রথম দিন সারা দিনের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ৯ হাজার টাকা। এর পর প্রতিদিনের জন্য ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তবে যদি কুনমিংয়ের কোনো ডাক্তার আপনাকে চিকিৎসার জন্য কুনিমং আসার সুপারিশ করে তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আপনি ভিসা পেয়ে যাবেন।বাংলাদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ডভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট কিনুন

এই লেখাটি যখন শেষ করেছি তখন দৈনিক পত্রিকাসমূহের অনলাইন সংস্করণে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ খবর দেখলাম। একটি হলো, জাতীয় ঐক্যমত কমিশন জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে পাঠিয়েছে। আমি খসড়াটি পড়েছি। আর একটি হলো, বিএনপি নেতা মঈন খান বলেছেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। ড. মঈন খান বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেননি। আমি সময় ও সুযোগমত বিস্তারিত ব্যাখার ইচ্ছা রাখি।

সূত্র, ইনকিলাব