‘ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি’, এ উসিলা দিয়ে গত ১৩ জুন ভোরে ইরানে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসী দেশ ইসরাইল। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইরানও ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। ফলে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, এ যুদ্ধ পুরো বিশ্বের স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য যে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের মদতপুষ্ট ইসরাইল একমাত্র দায়ী, তাতে সন্দেহ নেই। তারা ইসরাইলকে সমর্থন দিচ্ছে। ইরান-ইসরাইলের চলমান সংঘাত ইস্যুতে গতকাল বিবৃতি দিয়েছে বিশ্বের উন্নত সাত দেশের জোট জি-৭। অর্থনীতিতে শীর্ষ শক্তিধর এই জোটের সদস্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা ও ইতালি। দেশগুলো কানাডায় চলমান জি-৭ সম্মেলনে দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ বিবৃতি দিয়ে সরাসরি ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন করেছে। বিবৃতিতে জোটের নেতারা ‘ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে’ বলে মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, আমরা ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি। এর পাশাপাশি ইরান ‘আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং সন্ত্রাসের প্রধান উৎস’ বলে তারা উল্লেখ করেন। তারা বলেছেন, আমরা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছি, ইরান কখনই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, জি-৭ এর এই বিবৃতি ইসরাইলকে আরও আগ্রাসী এবং যুদ্ধ সম্প্রসারিত করাকে উৎসাহী করবে। অন্যদিকে, গত সোমবার ইরানে ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে মুসলিম বিশ্বের ২১টি দেশ। এক খোলা চিঠির মাধ্যমে তারা এ নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইরান-ইসরাইল সংঘাতের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু ওই দুই দেশের জন্য নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর ফলে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। দেশগুলো জরুরি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো হচ্ছে- মিসর, আলজেরিয়া, বাহরাইন, ব্রুনেই, চাদ, কোমোরোস, জিবুতি, গাম্বিয়া, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সউদী আরব, সুদান, সোমালিয়া, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। চিঠিতে দেশগুলো ¯পষ্টভাবে বলেছে, আমরা ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলার নিন্দা জানাই এবং একই সঙ্গে ইরানকেও আহ্বান জানাই, যেন তারা উত্তেজনা না বাড়ায়। আমাদের মূল লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, মুসলিম বিশ্বের ২১টি দেশের একযোগে যুদ্ধবিরতির এই আহ্বান নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক বার্তা।

ইসরাইল যখন ইরানে হামলা চালায়, তখন তার ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এটি ইসরাইলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িত নয়। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলার সপ্তাহ খানেক আগে নিজে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে নাকি অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পারমাণবিক আলোচনার আগে যেন এ ধরনের হামলা থেকে বিরত থাকেন। নেতানিয়াহু তার সেই অনুরোধ রাখেননি। তবে ইসরাইল হামলা চালানোর পর ট্রাম্প ইরানের উদ্দেশ্যে ‘আরও ভয়াবহ হামল আসছে’, চুক্তি করো, ‘নইলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না’ এবং ‘আমরা সবই আগে জনতাম’ ইত্যাদি বক্তব্য দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, একেক সময় একেক কথা বলা ট্রাম্পের চরিত্র। তার কথার মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে। ট্রাম্প তার শপথ গ্রহণের ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে গর্বের উত্তরাধিকার হবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভূমিকা।’ অথচ এখন তার বক্তব্যে সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার অনুপস্থিত। নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তিনি উদ্যোগ নেবেন। সেটিও তিনি বন্ধ করতে পারেননি। যদিও তার মনোভাবে বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধ বা শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো প্রবণতা রয়েছে, তারপরও তার কার্যকর কোনো উদ্যোগ তিনি নিতে পারছেন না। চলমান জি-৭ সম্মেলনেও তিনি ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধে বা যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বরং বিবৃতির মাধ্যমে ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছেন। তিনি তার ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’র প্রতিশ্রুতির পক্ষ নিতে পারেননি। স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। জি-৭ নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে একতরফা বিবৃতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের সেই পুরণো আধিপত্যবাদী, সা¤্রাজ্যবাদী এবং চরম মুসলমান বিদ্বেষী নীতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা মিলে কীভাবে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো সমৃদ্ধ দেশে হামলা চালিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে, লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে, তা সকলেরই জানা। ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করাই এসব হামলার উদ্দেশ্য ছিল। এখন সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলকে ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের হত্যার মাধ্যমে নিশ্চহ্ন করার লক্ষ্যের পাশাপাশি ইরানে হামলা চালিয়েছে। তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারার নীতি নিয়ে মুসলমান নিধন ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাবিশ্বের ইতিহাস হচ্ছে, যুদ্ধ, আগ্রাসন, মানবতাবিরোধী ও সা¤্রাজ্যবাদী নীতি অবলম্বন করে বিভিন্ন দেশকে তাদের কলোনিতে পরিণত করা। অন্যের সম্পদ লুট করে ধণী হওয়া। বাস্তবতা হচ্ছে, এখন তারা অর্থনৈতিকভাবে যেমন ক্ষয়ীষ্ণুতার দিকে, তেমনি তাদের জনসংখ্যাও ক্ষয়ীষ্ণু হয়ে পড়েছে। জি-৭ দেশগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তাদের জন্মহার অত্যন্ত নি¤œমুখী এবং বৃদ্ধ জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের কর্মক্ষম শ্রমশক্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দেখা যাচ্ছে, তারা যেসব দেশে হামলা চালিয়ে লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে, তারাই এখন তাদের দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে তাদের জাতিসত্ত্বার একটি বড় অংশ ভিনদেশী হয়ে পড়ছে। তাদের বর্ণবাদী ও তথাকথিত শ্বেতাঙ্গ আভিজাত্য হুমকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চীন এককভাবে বিশ্বে তাদের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। তাদের একতরফা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দেশটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামীতে এক চীনকে ঠেকানো তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যবাদ ঠেকানোর জন্য মুসলিম বিশ্বের ঐক্য এখন সময়ের দাবি। আশার বিষয়, ইরানে ইসরাইলের অন্যায় হামলার বিরুদ্ধে মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে। ২১টি দেশ ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে এটা প্রতীয়মান হয়। তবে ইসরাইলের সন্ত্রাসী আচরণ এবং তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে শুধু বিবৃতি দিলে হবে না, এরজন্য কার্যকর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা রাখতে হবে। বিবৃতি যদি শুধু ‘লিপ সার্ভিসে’ পরিণত হয় এবং যুদ্ধ বন্ধে কোনো ভূমিকা না রাখে, তাহলে তা অর্থহীন। এক্ষেত্রে ওআইসিকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ কবে বন্ধ হবে, তা কেউ জানে না। পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলকে দিয়ে যুদ্ধ লাগিয়ে যে মুসলমানদের হত্যার লাইসেন্স দিয়েছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার কথা বললেও তা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে পারছেন না। ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মতো আলোচনার কথা বললে হবে না। এক্ষেত্রে তাকে জোরালো ভূমিকা নিয়ে উভয় পক্ষকে আলোচনায় বাধ্য করতে হবে। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধানের কথা বলেছে। ইরানও আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, ইসরায়েল যদি হামলা বন্ধ করে, তাহলে ইরান আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি আলাপের ভিত্তিতে তিনি এ তথ্য জানিয়েছেন। এ প্রেক্ষিত, ট্রাম্পের জন্য বড় সুযোগ হয়ে এসেছে। তিনি উদ্যোগী হলে আলোচনার মাধ্যমে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বরাবরই যুদ্ধবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে আসছে। গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে কয়েক মাস আগে বিশ্বজুড়ে ডাক দেয়া ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে দেশটির জনগণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তার আগে গাজায় ইসরাইলি হামলায় মুসলমান হত্যার প্রতিবাদে দেশটির শিক্ষার্থীরা ব্যাপক প্রতিবাদ করেছে। এর মাধ্যমে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। এছাড়া ট্রাম্পের অভিবাসী নীতির কারণেও দেশটিতে বিক্ষোভ ও অশান্তি চলছে। এ প্রেক্ষাপটে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার যুদ্ধবিরোধী মনোভাব প্রকাশ ঘটালে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তিনি যে আলোচনার কথা বলেছেন, তা দ্রুত শুরু করতে হবে। শুধু আলোচনায় বসলেই হবে না, আলোচনার ইতিবাচক ফলাফল আসতে হবে। সকলে এখন ট্রাম্পের আলোচনার কথা এবং তার বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রাম্প বিশ্বে যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন, তা ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধের মাধ্যমে শুরু করতে পারেন। এতে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারেরও দাবিদার হতে পারেন।

সূত্র, ইনকিলাব