আধুনিক বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা লইয়া আলোচনার সূত্রপাত করিলেই নোবেলজয়ী আল গোরের নাম উচ্চারণ করিতেই হইবে। তাহার রচিত গ্রন্থসমূহে কেবল পরিবেশগত সংকট নয়, বরং সমাজের গভীরতর অন্তর্জগতে যে এক অবক্ষয়ের ধারা চলিতেছে, তাহারও তীব্র চিত্রাঙ্কন রহিয়াছে। বিশেষত, তাহার এক লেখায় তিনি বলিয়াছেন যে, সমাজ হইতে রিজন তথা যৌক্তিকতা ক্রমাগত বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে। তিনি তাহার 'আর্থ ইন দ্য ব্যালান্স' গ্রন্থে এক স্থানে গভীর শঙ্কা ব্যক্ত করিয়া বলিয়াছেন, 'আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ লইয়া সম্মিলিতভাবে যুক্তি করিবার ক্ষমতা হারাইয়াছি।' তার বক্তব্যের মর্মার্থ হইতেছে-সমাজ ক্রমাগত যুক্তিহীন, আবেগচালিত ও আত্মবিস্মৃত এক প্রবাহে ভাসিয়া যাইতেছে। আল গোরের এই ভাবনাটি এক সর্বব্যাপী মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি, যাহা তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে আজ স্পষ্ট হইয়া যাইতেছে।

একটি দেশ বা জাতি যখন যৌক্তিকতা ও বিবেচনাবোধ হারাইয়া ফালায়, তখন তাহার জাতি গঠনের স্বপ্ন এক মরীচিকায় পরিণত হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে যাহা এক মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ ছিল-সময়ে সময়ে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হইয়াছিল, তাহারা মনে করিয়াছিল, আমরা এক জাতি, আমাদের আছে এক ইতিহাস, এক ভবিষ্যৎ; কিন্তু এই আশা, এই চেতনা বারবার পথ হারায়। তৃতীয় বিশ্বের নানান দেশে দেখা যায়, যেই জাতি বারংবার ঐক্যবদ্ধ হইতে চাহিয়াছে, তাহারাই আবার বারংবার বিভক্তির পথে হাঁটিয়াছে। ইহার কারণ কী? যৌক্তিকতার লোপ, দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং সর্বোপরি আত্মপরিচয়ের অভাব?

এই প্রক্রিয়াটি যদি আমরা আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান করি, তাহা হইলে দেখিব, একসময় যাহারা ঐক্য গঠনের স্বপ্ন দেখিত, তাহারাই আবার ঐক্য ভাঙিবার নায়ক হইয়া উঠে; এবং এই চক্র চলিতে থাকে-একবার ঐক্য, পরক্ষণে বিচ্ছিন্নতা; পুনরায় ঐক্য, আবারও ভাঙন। এই খেলার যেন কোনো শেষ নাই। ইহা এমন এক অবস্থা, যাহা নিউটনের কণাপুঞ্জ বিশ্লেষণের মতো ক্ষুদ্রত্বে পৌঁছায়। জাতি ভাঙিতে ভাঙিতে আজ অণুতে পরিণত হইয়াছে, অণু হইতে পরমাণু, পরমাণু হইতে ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রনের মধ্যে ছিন্নবিচ্ছিন্ন। যেন জাতি বলিয়া কিছু ছিল না, কেবল কিছু কণার সমষ্টি-যাহারা কেবল নিজের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান; কিন্তু পারস্পরিক সংযুক্তির বন্ধনে আবদ্ধ নহে।

এখন প্রশ্ন হইতেছে, পরমাণু যদি অণু না গঠন করে, তাহা হইলে বৃহৎ পদার্থের অস্তিত্ব কী করিয়া সম্ভব? যদি শতসহস্র অণুগুচ্ছ সম্মিলিত না হয়, তাহা হইলে কেহ 'জাতি' নামক এক মহাসত্তাকে কী করিয়া রূপ দান করিবে? জাতি গঠনের এই মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি যাহারা লইয়াছিল, তাহাদের উত্তরাধিকার কি এই সত্য অনুধাবন করিতে পারিতেছে? ইতিহাসের শিক্ষা হইতে বিচ্ছিন্ন এক সমাজ সর্বদাই আত্মঘাতী হয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের এই বেদনাদায়ক দশা। ইহারা উন্নতির সকল উপকরণ লইয়াও উন্নতির কাতারে পৌঁছাইতে পারে না, কারণ ইহাদের ভিতর ঐক্যের স্থায়িত্ব নাই। ইহারা কেবল ভাঙিতে জানে, গড়িতে নহে।

যদি আমরা আত্মানুসন্ধানের পথ ধরিয়া পুনরায় যুক্তির আলোক জ্বালাইতে না পারি, তাহা হইলে এই অবিভক্ত অণু-পরমাণুর জাতি চিরকাল তৃতীয় বিশ্বের অন্ধকারেই রইয়া যাইবে। সেই অন্ধকার ভেদ করিবার জন্য চাই যুক্তি, সংলাপ, এবং সর্বোপরি-জাতিগত ঐক্য।

সূত্র, ইত্তেফাক