অনেকদিন ধরে করনীতি এবং কর বাস্তবায়ন পৃথক করার আলোচনা চলছে। সম্প্রতি তা বেশ গতি পেয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত রয়েছে। আজকের প্রবন্ধে আমাদের দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় নীতি ও বাস্তবায়নের কিছু পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করব।

মাঠ পর্যায় থেকে প্রচুর পত্র এনবিআরে গৃহীত হয়। এসব পত্রের অধিকাংশই অংশীজনরা প্রেরণ করেন। এসব পত্রে যেসব বিষয়ে মতামত চাওয়া হয় তার মধ্যে কিছু হলো আইনের জটিলতা বা আইনের বিধানে কোনো বৈপরীত্য নিয়ে। তবে প্রচুর পত্র আসে খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে। যেমন কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাট হার কত শতাংশ হবে, কোনো ক্ষেত্রে উপকরণ কর রেয়াত পাওয়া যাবে কিনা, কোনো বিক্রয় রফতানি হিসেবে গণ্য হবে কিনা, কোনো ক্ষেত্রে উৎসে ভ্যাট কর্তন করতে হবে কিনা ইত্যাদি। আবার অমুক প্রতিষ্ঠান এভাবে কাজ করে, আমরাও একইভাবে কাজ করতে পারব কিনা, আমরা আমদানি করার সময় ভ্যাট পরিশোধ করেছি, বিক্রি করার সময় আবার কেন ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে ইত্যাদি ধরনের পত্রও এনবিআরে গৃহীত হয়। এভাবে এনবিআরের কাছে নানা বিষয়ে জানতে চেয়ে এত বেশিসংখ্যক পত্র গৃহীত হয় যে এনবিআরের বর্তমান জনবল দিয়ে সব পত্রের জবাব দেয়া দুঃসাধ্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমার আজকের আলোচনার বিষয় হলো, নীতি পর্যায়ে কোন কাজ সম্পাদিত হওয়া সমীচীন এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে কোন কাজ সম্পাদিত হওয়া সমীচীন সে বিষয়ে ধারণা দেয়া। অর্থাৎ নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে একটা সীমারেখা টানার চেষ্টা করা।

একটা আদর্শ ভ্যাট ব্যবস্থায় বা কর ব্যবস্থায় এ ধরনের সব মতামত, উত্তর, জবাব ইত্যাদি নীতি বিভাগ থেকে দেয়া হয় না, দেয়া যায় না, দেয়া সমীচীন নয়। আরো সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে নীতির কোনো ব্যাখ্যা নীতি থেকে দেয়া হয় না। এটা হলো, পত্র লিখে তা পাঠ করে দিয়ে আসার মতো। পত্র লিখে পত্র যদি লেখককেই পাঠ করে দিয়ে আসতে হয়, তাহলে পত্র লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সঠিক পদ্ধতি হলো, নীতি প্রয়োগ করবেন বা নীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করবেন প্রফেশনাল অর্থাৎ কনসালট্যান্টরা। নীতি বিভাগ থেকে শুধু নীতির পরিবর্তন, সংশোধন, পরিমার্জন, নতুন নীতিনির্ধারণ ইত্যাদি কাজ করা হবে। এ কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য নীতি বিভাগ বাস্তবায়ন বিভাগসহ অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করবে। একটা আদর্শ কর ব্যবস্থার এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

প্রায়ই আমরা বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দিই। বর্তমান বিষয়ে আমি উন্নত বিশ্ব থেকে একটা উদাহরণ পেশ করছি। আমি ২০১৬ সালে একটা টিমের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান ট্যাক্সেশন অফিস (এটিও) পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। এটিও থেকে অস্ট্রেলিয়ান জিএসটি লেজিসলেশনের একটা করে কপি আমাদের সবাইকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ান জিএসটি লেজিসলেশনের কাভার পাতায় লেখা রয়েছে ‘Disclaimer: No person should rely on the contents of this publication without first obtaining advice from a qualified professional person.’ অর্থাৎ কোয়ালিফায়েড প্রফেশনাল পারসনের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া ছাড়া কাউকে জিএসটি লেজিসলেশনের ওপর নির্ভর না করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাহলে বুঝুন যে কোয়ালিফায়েড প্রফেশনাল পারসনের গুরুত্ব কতটুকু। যারা আইন নিয়ে কাজ করবেন অর্থাৎ যাদের আইন মেনে চলার প্রয়োজন হবে, তারা আইনের যেকোনো বিষয়ে কোয়ালিফায়েড প্রফেশনাল পারসনের কাছ থেকে পরামর্শ নেবেন। অর্থাৎ নীতির ব্যাখ্যা দেবেন, নীতির অর্থ বুঝিয়ে দেবেন প্রফেশনালরা। নীতিতে কোনো ভুল-ভ্রান্তি থাকলে বা তাদের কোনো পরামর্শ থাকলে তা তারা নীতিনির্ধারকদের নজরে আনবেন। তখন নীতিনির্ধারকরা প্রয়োজনে নীতি সংশোধন করবেন। তাহলে দাঁড়ায় যে ভ্যাট ব্যবস্থায় বা কর ব্যবস্থায় এমন একটা প্রফেশনাল শ্রেণী থাকতে হবে। এমন একটা প্রফেশনাল শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় এখনো এমন একটা প্রফেশনাল শ্রেণী গড়ে ওঠেনি।

প্রফেশনাল অর্থাৎ কনসালট্যান্টরা নীতি বাস্তবায়নকারী ও ভ্যাটদাতাদের মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করে থাকেন। একজন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীকে অনেক আইন পরিপালন করতে হয়। তাকে ভ্যাট আইন, কাস্টমস আইন, আয়কর আইন, পরিবেশ আইন, কোম্পানি আইন, শিল্প আইন, শ্রম আইন, বিস্ফোরক আইন এবং আরো অনেক আইন পরিপালন করতে হয়। একজন উদ্যোক্তার নিজের পক্ষে এতগুলো আইন জানা সম্ভব হয় না। তাই তাকে প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রফেশনালের সহায়তা নিতে হয়। ভ্যাট আইনের ক্ষেত্রে ভ্যাট কনসালট্যান্টরা উদ্যোক্তাদের সহায়তা করবেন, এ হলো আদর্শ ভ্যাট ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমরা আদর্শ ভ্যাট ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে রয়েছি। প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভ্যাট কনসালট্যান্ট আমাদের দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় নেই। সঠিকভাবে বলতে গেলে অতি নগণ্য সংখ্যক ভ্যাট কনসালট্যান্ট বর্তমানে আমাদের দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় রয়েছে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভ্যাট কনসালট্যান্ট গড়ে তোলার মতো দৃশ্যমান প্রচেষ্টাও নেই। বরং এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে কনসালট্যান্টদের কোনো কোনো সময় বিরূপভাবে চিত্রায়িত করে, কনসালট্যান্ট শ্রেণী গড়ে না তোলার পক্ষে অনেকে বক্তব্য দিয়ে থাকেন।

ভ্যাট নীতি ভ্যাট বাস্তবায়ন থেকে আলাদা করতে হবে, এভাবে না বলে আমরা যদি বলি যে ভ্যাট নীতি এবং ভ্যাট বাস্তবায়ন এ দুটি বিভাগের কাজের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানতে হবে, অর্থাৎ পার্থক্য থাকতে হবে, তাহলে সম্ভবত বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়। সীমারেখা অনুযায়ী যার কাজ তিনি করবেন। ভ্যাট ব্যবস্থার চারটি শ্রেণী: নীতিনির্ধারণকারী, নীতি বাস্তবায়নকারী, কনসালট্যান্টস ও ভ্যাটদাতা। এ চার শ্রেণীর প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজটুকু শিখতে হবে এবং সে অনুযায়ী পরিপালন করতে হবে। তাহলে ভ্যাট নীতি ও ভ্যাট বাস্তবায়ন আলাদা হবে। কেবল তাহলেই আমরা একটা উত্তম ভ্যাট ব্যবস্থা পেতে পারি।

ড. মো. আব্দুর রউফ: সদস্য (মূসক নীতি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

সূত্র, বণিক বার্তা