শিক্ষা মানুষের জীবনে আনে ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের হতাশার কারণ। সম্প্রতি ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে মানসিক চাপ ও অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষার্থীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। কঠিন সিলেবাস, চরম প্রতিযোগিতা, পর্যাপ্ত মানসিক সহায়তার অভাব—এসব মিলিয়ে অনেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মুখস্থনির্ভরতা, সৃজনশীলতার অভাব এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংগতিহীন চাকরির ক্ষেত্রের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে সময় অনুপযোগী পাঠ্যসূচি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে অনেক কম শিক্ষক এবং শিক্ষকদের মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের অভাবে পুরো ব্যবস্থাটি আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি শহর ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাঠামোগত বৈষম্য, গ্রামের শিক্ষকদের মানের অভাব, প্রযুক্তির ব্যবহারে অদক্ষতা গ্রামের শিক্ষার্থীদের আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। শহর-গ্রাম মিলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো ডিজিটাল ক্লাসরুমের যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

কিন্তু বিশ্ব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যেতে পারছে না। কারণ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং এআই প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে টিকে থাকতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও অগ্রসর করা দরকার।

অথচ আমাদের দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মৌলিক চাহিদা পূরণেই ব্যর্থ।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্লেষণী চিন্তা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ অর্জন করবে। শিক্ষার্থীরা শুধু একাডেমিক জ্ঞান অর্জন করবে না, শারীরিক ও মানসিকভাবেও বলবান হবে। এ জন্য পাঠ্যসূচিতে মানসিক স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দলগত কাজ, বিতর্ক, উপস্থাপনার সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন, যা কর্মজীবনে সফল হতে সহায়ক হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটানো জরুরি। যেকোনো তথ্য অন্ধভাবে মেনে না নিয়ে প্রশ্ন করার এবং নিজস্ব মতামত গঠনের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সৃজনশীলতা ও প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষার সংযোজন, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। পরীক্ষাকেন্দ্রিক মূল্যায়নের পরিবর্তে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং পোর্টফোলিও অ্যাসেসমেন্টের ওপর জোর দেওয়া উচিত। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা যাবে এবং তাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক সহায়তা করা সম্ভব হবে। শুধু জ্ঞান নয়, দক্ষতা, মনোভাব এবং প্রয়োগযোগ্যতাকেও মূল্যায়নের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ এবং অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও গবেষণামূলক কাজে উৎসাহিত করতে হবে। স্কুল পর্যায় থেকেই বিজ্ঞান মেলা, প্রজেক্ট প্রদর্শনী এবং ইনোভেশন চ্যালেঞ্জের আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসু মন ও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার জন্ম দিতে হবে। শিল্প এবং একাডেমিয়ার মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে গবেষণালব্ধ জ্ঞান সরাসরি সমাজের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়।

পাশাপাশি নীতিনির্ধারণে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও মতামতকে মূল্য দেওয়া গেলে শিক্ষাব্যবস্থা আরও বাস্তবমুখী হয়ে উঠবে। শিক্ষাসংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে একটি কার্যকর ও বাস্তবসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা প্রয়োজন, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত বিশ্বের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।

উপরোক্ত উদ্যোগগুলো সম্পন্ন করার জন্য জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। তাহলে আমরা একটা মানসম্পন্ন ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দিকে অগ্রসর হতে পারব।

শিক্ষাব্যবস্থার এই কাঠামোগত পরিবর্তন শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎই নয়, বরং দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথকেও সুগম করে তুলবে। একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগের ফলে।

সূত্র, আজকের পত্রিকা