জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের টানা ৬১ দিনের আন্দোলন যে স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না, তা ব্যবসায়ীসহ সর্বমহলই বলে আসছিল। দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে জেনেও দাবি আদায়ে আন্দোলনকারীদের অটল অবস্থান সন্দেহজনক বৈকি। আর সেই সন্দেহ যে অমূলক নয়, মঙ্গলবার যুগান্তরের বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে আন্দোলনের আড়ালে সরকারবিরোধী এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের নীলনকশার কথাও। এনবিআরসংশ্লিষ্ট অনেকে একে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে কাশিমবাজার কুঠিতে বসে মীরজাফরদের ষড়যন্ত্রের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। এ সেক্টরের সাধারণ কর্মকর্তাদের আবেগ আর বিশ্বাসকে পুঁজি করে রাজস্ব খাতকে কার্যত অচল ও সরকার উৎখাতই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য।

জানা যায়, সংশোধিত রাজস্ব অধ্যাদেশের খসড়া গেজেটের বিরুদ্ধে প্রথমদিকে মৃদু আন্দোলন শুরু হলেও তা ক্রমেই ধূমায়িত হতে থাকে। দ্বিতীয় ধাপে গেজেট বাতিলের আন্দোলন বেশ জোরেশোরে উত্তাপ ছড়ায়। কিন্তু জুনের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় পেছনে থাকা কুশীলবরা। অধ্যাদেশ বাতিলের ইস্যু বাদ দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি সামনে নিয়ে আসে। এর পরপরই সবকিছু অচল করে দিয়ে কুচক্রী মহল হঠাৎ ‘শাটডাউন’ কর্মসূচিতে চলে যায়। ওই সময় সভা-সমাবেশ থেকে কেউ কেউ সরকারের পদত্যাগও দাবি করে। তখনই আসল উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, মাস্টারমাইন্ডদের কেউ কেউ দেশি-বিদেশি চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রীতিমতো সরকার পতনের রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছিলেন। কথিত এনবিআর সংস্কার আন্দোলনের নামে যারা সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, তাদের ৬৬ জনের নামের তালিকা যুগান্তরের কাছে এসেছে। দেখা গেছে, দুই ক্যাডারের ১২ মাস্টারমাইন্ড থেকে শুরু করে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার, পরিদর্শক, নাজির ও সিপাহি পদমর্যাদার ব্যক্তিও এ তালিকায় রয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউনের মতো কর্মসূচি পালন করার কোনো সুযোগ নেই। উপরন্তু এনবিআর হলো সরকারের ব্লাড সার্কুলেশনের পাইপলাইন। এনবিআর-এর ইতিহাসে এ ধরনের আন্দোলনের নজিরও নেই। ফলে এ আন্দোলনের পেছনে কারা কীভাবে ইন্ধন দিয়েছে, জাতীয় স্বার্থেই তা খুঁজে বের করা দরকার। আমরা মনে করি, অফিসের কাজ বন্ধ রেখে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত কাজ। জনসেবাকে হুমকিতে ফেলে সরকারের সেবক হয়ে সরকারকেই জিম্মি করার কোনো সুযোগ তাদের নেই। সার্ভিস রুলেও এ বিষয়টির স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আন্দোলন চলাকালে আমরা আন্দোলনকারীদের বারবার আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। পরিতাপের বিষয়, সে আহ্বানে তারা কর্ণপাত করেনি। এখন বিষয়টি পরিষ্কার যে, উদ্দেশ্য যখন ভিন্ন, তখন ‘চোরে কেন শুনিবে ধর্মের বাণী’?

ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যারা অচলাবস্থাকে পুঁজি করে দেশ ও দশের ক্ষতি চায়, তাদের ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই। তারা দেশবিরোধী কুচক্রী, যথাযথ তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তাদের প্রাপ্য। ২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলনের’ মাধ্যমে দেশের স্থবির অর্থনীতিকে গতিশীল করার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাকে কোনোভাবেই নস্যাৎ করতে দেওয়া যাবে না। এজন্য সরকারকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের দিকে এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা।

এনবিআর

সূত্র, যুগান্তর