উচ্চাকাঙ্ক্ষী যেকোনো রাজনীতিবিদের কাছে এখন যেন সহজ একটা অস্ত্র সবসময় প্রস্তুত থাকে। অসন্তুষ্ট ভোটারদের কাছে নিজেদের পুরনো শাসকগোষ্ঠীর ভুল পলিসির ভুক্তভোগী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে আরাম পায় তারা।

উচ্চাকাঙ্ক্ষী যেকোনো রাজনীতিবিদের কাছে এখন যেন সহজ একটা অস্ত্র সবসময় প্রস্তুত থাকে। অসন্তুষ্ট ভোটারদের কাছে নিজেদের পুরনো শাসকগোষ্ঠীর ভুল পলিসির ভুক্তভোগী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে আরাম পায় তারা। বর্তমান ব্যর্থতা ঢাকতে আগের সরকারের ভুলের ওপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারলে যেন তারা বেঁচে যায়। অনেক দেশেই আমরা দেখছি, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে সাবেক সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট নীতি অথবা অন্য কোনো গোষ্ঠী কিংবা বিদেশীদের ষড়যন্ত্রের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ে। এ কৌশল বিশেষভাবে কার্যকর হয় যখন হতাশ গোষ্ঠীটি একটি আলাদা এবং (সাধারণত) বড় আকারের ভোটার জনগোষ্ঠী এবং যাদের দোষ দেয়া হচ্ছে তারা হয় ভোট দেয় না, অথবা ভোটের মাঠে খুবই নগণ্য শক্তি। এ কৌশলের সৌন্দর্য হলো যতক্ষণ অন্য কাউকে দোষারোপ করা যায়, ততক্ষণ হতাশ ভোটারদের কাছ থেকে কিছু চাওয়ার প্রয়োজন নেই; কেবল তাদের নিপীড়ন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট।

আমেরিকান প্রাবন্ধিক এইচএল মেনকেন বলেন, ‘প্রতিটি জটিল সমস্যার উত্তর আছে; সহজ-সরল আর ভুল।’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, ভিকটিম বা নিপীড়িত হওয়ার যুক্তি এ বর্ণনারই অংশ, যা ব্যাখ্যা করে কেন এ ধরনের সমাধান প্রায়ই পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তোলে।

উদাহরণস্বরূপ, ভারতের অনেক উদীয়মান শহরে স্থানীয় রাজনীতিকরা তাদের স্থানীয় নাগরিকদের জন্য ন্যূনতম চাকরির কোটা নির্ধারণের প্রস্তাব দিচ্ছেন। তাদের যুক্তি, নতুন ও গুণগত বেসরকারি চাকরিগুলোয় অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীরা খুব বেশি জায়গা দখল করছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, যে প্রাণবন্ত পরিবেশ এ শহরগুলোয় তৈরি হয়েছে, সেটাই দেশের অন্য অঞ্চল থেকে সেরা মেধাবীদের আকৃষ্ট করেছে। অভিবাসীদের চাকরির আধিক্য বৈষম্যের ফল না হয়ে বরং তাদের যোগ্যতারই প্রতিফলন।

ধরা যাক, একজন রাজনীতিক চাকরির উচ্চপদে স্থানীয় নাগরিকদের জন্য একটি কোটা চালু করলেন। যদি নীতিটি খুব কড়াকড়ি না হয়, তাহলে এটি কিছু ভালো করতে পারে, কারণ উচ্চ পদে থাকা স্থানীয়রা নতুন স্থানীয় কর্মীদের গাইডেন্স, পরামর্শ ও নেটওয়ার্কিং সহযোগিতা করতে পারে (যেমনটা যেকোনো আত্মীয়তাভিত্তিক গোষ্ঠী করে)। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিকরা সাধারণত মাঝারি পদক্ষেপে সন্তুষ্ট থাকেন না। তারা চায় বড় ধরনের কোটা।

এখানেই সমস্যার শুরু। প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চ পদে যোগ্যতার অভাবে স্থানীয় কর্মী নিয়োগ দিলে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা কমে যাবে। স্থানীয় প্রতিযোগিতার মধ্যেই যদি সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারত। কিন্তু যখন প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য শহরের প্রতিযোগীদের বা বিদেশী উৎপাদনকারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখন তা বড় সমস্যায় পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত কোম্পানির বৃদ্ধি থেমে যাবে, সার্বিকভাবে কম কর্মী নিয়োগ দেবে (স্থানীয়রাও বাদ যাবে না), এমনকি হয়তো ব্যবসাবান্ধব অন্য শহরে চলে যাবে।

সারকথা হলো, দক্ষ অভিবাসীরা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রতিযোগিতাপূর্ণ করে তোলে। এতে সবসময় উচ্চপদে না হলেও আরো বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় স্থানীয়দের জন্য। অভিবাসী কর্মীদের দোষারোপ করা সহজ রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হতে পারে। কিন্তু সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিবিদদের অনেকে দাবি করেন যে অনেক স্থানীয় যোগ্য শিক্ষার্থীকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির সুযোগ দেয়া হয় না। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশী শিক্ষার্থীর ভর্তির আসন সংখ্যা সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত, ৩১ শতাংশ নয়। কিন্তু যদি বিদেশী শিক্ষার্থীরা শুধু মেধার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয় তা নিয়ে বিরোধিতা করার তেমন সুযোগ নেই। কিন্তু বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেঁধে দিলে শিক্ষার্থীদের গড় মান কমে যাবে। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে আসতে নিরুৎসাহিত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন সংখ্যা সীমিত করা ছাড়াই বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গড় মানসম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে যাবে। ফলে উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন বিদেশী শিক্ষক বা গবেষকের সংখ্যাও কমে আসবে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এ ধরনের নীতি দীর্ঘমেয়াদে বড় ক্ষতি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বহু মৌলিক গবেষণা করা হয়েছে, যার ভিত্তিতে মার্কিন কোম্পানিগুলো বিশ্বে উদ্ভাবনের নেতৃত্বে রয়েছে। বিশ্বের সেরা মেধাবীদের দূরে রাখার অর্থ হলো অন্য দেশগুলো উদ্ভাবনে এগিয়ে যাবে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদরা সিঙ্গাপুর থেকে এক্ষেত্রে কিছু শিখতে পারে। একবার সিঙ্গাপুরের এক মন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, তারা চীনের বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের সিঙ্গাপুরের বিদ্যালয়ে আনার একটি কর্মসূচি চালু করলে অভিভাবকদের অনেকেই তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ ছিল, চীনা শিক্ষার্থীরা প্রথমে পিছিয়ে থাকে (কারণ ইংরেজি শিখতে হয়), কিন্তু তৃতীয় বছরে তারা শীর্ষে উঠে আসে। তাদের সন্তানদের শীর্ষস্থান অর্জনের সুযোগই থাকে না। তাদের প্রশ্ন ছিল, কেন এমন প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে।

উত্তরে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে বিশ্বে প্রতিযোগী হয়ে ওঠা ছাড়া সিঙ্গাপুরের সামনে আর কোনো পথ নেই। ১৫ বছর পর যখন আপনাদের সন্তান চাকরি খুঁজবে, তখন আপনারা কি চান চীনা শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক নাকি একে অন্যের জন্য প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়াক। তারপর অভিভাবকরা বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং তাদের অভিযোগও দূর হয়।

অন্য দেশের বৈষম্যমূলক নীতি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে সংকুচিত করেছে সেটাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দোষারোপের শিকার অর্থনীতির একটা উদাহরণ। ২০০৪ সাল থেকে অ্যাপল যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখযোগ্য হারে পণ্য তৈরি কমিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন আইফোন উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে আইফোন আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, আইফোন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করলে এর দাম হবে আকাশছোঁয়া। এটি অন্য দেশে তৈরি হয় কারণ সেসব দেশ তা তৈরিতে বেশি দক্ষ ও ব্যয়সাশ্রয়ী।

ট্রাম্প প্রশাসনের ইচ্ছা অনুযায়ী যদি অ্যাপল আইফোন উৎপাদন ব্যবস্থা সেদেশে ফিরিয়ে নেয়, তাহলে উচ্চ মূল্যের কারণে বিশ্বে এর বিক্রি কমবে। অথচ অ্যাপলের বিপুল আয়ের উৎস আইফোন ব্যবহারকারীদের জন্য তৈরি উচ্চ মুনাফাসম্পন্ন সেবা যেগুলো অ্যাপ স্টোর, আইক্লাউড ও অ্যাপল মিউজিকের মাধ্যমে দেয়া হয়ে থাকে। আইফোনের ব্যবহারকারী কমে গেলে স্বাভাবিকভাবে এসব সেবা থেকে আয় কমবে। উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরানোর মাধ্যমে আইফোনের যে দাম দাঁড়াবে তার চেয়ে বেশি আয় কমার ঝুঁকি তৈরি হবে। এটিও দোষারোপের রাজনৈতিক কাঠামোয় নেয়া সিদ্ধান্তের ফল।

অন্যকে দোষারোপ করে অর্থনীতিকে নিম্নমুখী করার চেয়ে যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে ওপরে তোলা অনেক বেশি কার্যকর পন্থা। কিন্তু সে কথা রাজনীতিবিদদের বোঝানোই বড় চ্যালেঞ্জ।

রঘুরাম জি. রাজন: ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো বুথ স্কুল অব বিজনেসে ফাইন্যান্সের অধ্যাপক।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২৫

সূত্র, বণিক বার্তা