তরিকায়ে মুহাম্মদিয়ার সংস্কার আন্দোলন ভারতবর্ষের মুসলমানদের প্রথম আজাদির স্বপ্ন দেখিয়েছিল। দরুল হরব বা শত্রুকবলিত দেশে ইসলামের শৌর্যবীর্যকে পূনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এক মহান পুরুষ কঠিন লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সৈয়দ খান্দানের এই অকুতোভয় মুজাহিদের নাম নাম সৈয়দ আহমদ বেরলভি, যিনি বালাকোটের ময়দানে শিখদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। সৈয়দ আহমদ বেরলভি (রহ.)-এর ছোটবেলায় পড়ালেখার প্রতি তেমন ঝোঁক না থাকলেও শরীর চর্চার প্রতি ছিল প্রচ- আগ্রহ। ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। অসহায় মানুষকে ভালবাসতেন। তাদের ব্যক্তিগত কাজকর্মেও সহযোগিতা করতেন। যৌবনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে নওয়াব আমির খান পিন্ডারির সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। স্বপ্ন ছিল এ বাহিনী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কিন্তু যখন দেখলেন আমির ব্রিটিশদের বশ্যতা মেনে নিচ্ছেন, তখন তিনি সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নেন। ভাবতে থাকেন এদেশকে শত্রুমুক্ত করতে হলে অন্যপথ অবলম্বন করতে হবে।
মুসলমানদের তখন খুব দুর্দিন। তারা এটা মেনে নিয়েছিল যে, কখনই ব্রিটিশদের জুলুম, নির্যাতন থেকে তাদের আর মুক্তি নেই। ইংরেজ, শিখ ও হিন্দুদের অত্যাচারের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলছিল। এই জালিমরা মুসলিম নারীদের দাসীরূপে ব্যবহার করতো। ক্ষেতের ফসল নষ্ট করতো ও ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতো। সীমান্তের মসজিদগুলোকে মন্দির ও ঘোড়ার আস্তাবলে পরিনত করেছিল। একদিকে মুসলমানরা বিধর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত, অন্যদিকে ব্রিটিশ, হিন্দু ও শিখদের আধিপত্যের কারণে মুসলমানরা ইসলামি তাহজিব, তামাদ্দুন ভুলে গিয়ে পাশ্চাত্য ও হিন্দুয়ানি আদর্শ-সংস্কৃতি গ্রহণ শুরু করলো। তখন ভারতবর্ষের মুসলমানদের সামনে তিনটি পথ খোলা ছিল। হয়, ব্রিটিশদের গোলামী মেনে নিয়ে ভোগবাদে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া, না হয় সত্যের পথে অবিচল থেকে সকল মুসিবত ও অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়া। আর তৃতীয় পথটি ছিল প্রতিরোধের। যেটকু সামর্থ্য আছে, তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করা। সৈয়দ আহমদ বেরলভি শেষোক্ত তৃতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিলেন।
তিনি ১৮১৭ সালে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভি (রহ.)- এর ছাহেবজাদা আব্দুল আজিজ মুহাদ্দেসে দেহলভি (রহ.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। বায়াতের পর শাহ সাহেব সৈয়দ সাহেবের জন্য এই দোয়া করলেন যে, আল্লাহ তোমাকে বেলায়াতে আম্বিয়া ও বেলায়াতে আউলিয়া দান করুন। বেলায়াতে আম্বিয়া হচ্ছে, নবীদের পথ ও পদ্ধতি তথা সংস্কার, জিহাদ ইত্যাদি। আর বেলায়াতে আউলিয়া হচ্ছে, আউলিয়াদের পথ, তথা দ্বীনের মেহনত ও আত্মপরিশুদ্ধি। সৈয়দ সাহেব দেখলেন, নিজ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হলে জিহাদ-আন্দোলনের বিকল্প নেই। এজন্য তিনি তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া নামে স্বতন্ত্র একটি তরিকার জন্ম দেন। এই তরিকার মূল কথা হচ্ছে, হযরত রাসূলে করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলের (স.) তরিকা মেনে চলা।
সৈয়দ আহমদ বেরলভি মুসলিমদের আত্মশুদ্ধি ও জিহাদের প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ লক্ষ্যে তিনি পুরো ভারতবর্ষ চষে বেড়াতে থাকলেন। দিল্লী থেকে দাক্ষিণাত্য, পাটনা থেকে কোলকাতা, পাকিস্তান সীমান্ত থেকে আফগান সীমান্ত, বেনারস থেকে কানপুর, সেলুন থেকে এলাহাবাদ, লাখনৌ থেকে কান্দাহার, এমন কোন বড় শহর নেই, যেখানে তিনি সফর করেননি। প্রতিটি অঞ্চল থেকে মুসলিম যুবকরা পঙ্গপালের মতো তরিকায়ে মুহাম্মদিয়ার সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। এর মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন গোত্রের সর্দার, আলেম, ফকিহ, তরুণ, যুবক। তারা তার কাছে তরিকা ও জিহাদ আন্দোলনের বায়াত নিলেন। তিনি বয়স ও শক্তি সামর্থ্যরে বিবেচনা করে আলাদা আলাদা কাফেলা করে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ১৮২৪ সালের মধ্যেই পুরো ভারত উপমহাদেশে এ আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করে। সর্বত্র ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। ১৮২৬ সালে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হজ পালন করেন। অল্প কিছু দিনের জন্য হলেও একটি শরীয়াহভিত্তিক অঞ্চলের গোড়াপত্তন করেন তিনি। পাঞ্জতারকে রাজধানী করে এই রাষ্ট্র ঘোষণা করেন স্বয়ং সৈয়দ আহমদ বেরলভি। ৪ বছরের মতো এই শরীয়া রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ইংরেজ ও শিখদের চক্রান্ত, প্ররোচনায় ইসলামি শরীয়া আইনে অনভ্যস্থ কিছু স্বার্থান্বেষী মুসলিম মীরজাফরদের কারণে ইংরেজরা সুযোগ পেয়ে যায় এবং একদিন সুযোগ বুঝে কামানের গোলা নিক্ষেপ করে তছনছ করে দেওয়া হয় এর কেন্দ্র। পরে সৈয়দ সাহেব হিজরত করেন কাশ্মীরের দিকে।
১৮৩১ সালে কাগান ও কাশ্মীরের কয়েকজন মুসলমান সর্দার সৈয়দ সাহবেরে কাছে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সাহায্য প্রার্থী হন। সৈয়দ সাহেব তাদের সাহায্যের জন্য মুজাহিদ বাহিনীকে নির্দেশ দেন এবং নিজেও কাশ্মীরের বিপদসংকূল পথে যুদ্ধের জন্য রওয়ানা দেন। মুজাহিদ বাহিনী বালাকোট নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ১৮৩১ সালের ৬ মে মাটিকোট টিলার তীরে বালাকেট নামক স্থানে সৈয়দ আহমদ বেরলভি শাহাদাত বরণ করেন। তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে উদীয়মান একটি সংগঠিত ইসলামি শক্তির পতন ঘটে। হয়তো আল্লাহর ইচ্ছা তাই ছিল।
সৈয়দ আহমদ বেরলভি (রহ.) শাহাদাত বরণ করলেও তাঁর শিক্ষা, মেহনত পৃথিবীর তাবৎ মুসলমানের কাছে মডেল হয়ে রয়ে গেছে। উম্মাহর কাছে এক প্রেরণার বাতিঘর হয়ে বালাকোট ও তরীকায়ে মুহাম্মদিয়া চির জাগরুক। এই চেতনায় একদিন এই দেশ ব্রিটিশ মুক্ত হয়েছিল। এই চেতনায় আজও এদেশে ইসলামী জযবার ধ্বনি শোনা যায়। আজকের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন আফগানিস্থানও সেই আপোষহীন চেতনারই প্রতিফলন। বর্তমানে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনও সে পথেই হাঁটছে।
বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতে সৈয়দ আহমদ বেরলভি (রহ.)- এর খলিফা হযরত কারামত আলীর মাধ্যমে জৈনপুরী সিলসিলা প্রসার লাভ করেছে। বাংলাদেশে ফুলতলী, শর্ষিণা, সোনাকান্দাসহ বিভিন্ন দরবারের মাধ্যমে দ্বীনি তালিম ও তাযকিয়া জারি রয়েছে।
লেখক: পরিচালক, সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও অ্যাডুকেশন সেন্টার, বার্মিংহাম, ইউকে।