শিক্ষার্থী আন্দোলনের ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসা ইউনূস সরকারকে কাবু করতে শিক্ষার্থী আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির আয়োজন স্পষ্ট। বিভিন্ন জায়গায় অল্প সময়ের মধ্যেই বাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছে গোলমাল। বিভিন্ন স্থানে রাস্তা অবরোধ ও জনদুর্ভোগই নয়, প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়ের দিকেও থাবা দেয়া হচ্ছে।
মাস কয়েক ধরে শিক্ষার্থী ব্যানারে বিভিন্ন সড়কে অবস্থান, অবরোধে যান চলাচল বন্ধ হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। কিছু জায়গায় শিক্ষার্থী আন্দোলনের নামে গাড়ি ও সরকারি সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে মারধর করা বা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। কিছু ক্ষেত্রে, এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। মোটকথা, শিক্ষার্থী আন্দোলনের নামে বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে দেশের স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেও ব্যাহত করছে।
গত বছরের এ সময়ে গোটা দেশ ছিল ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন সহিংস হয় ১৫ জুলাই থেকে। এর পরিণতি ঘটে ৫ আগস্টে। দিনটিতে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা। গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আগুন, আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে আগুন।
এর আগের দিন ৪ আগস্ট, রোববার সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে সারাদেশে ১৮ জেলায় ব্যাপক সংঘাতের খবর। ১১৪ জনের মৃত্যু। খুব খেয়াল করবার বিষয়, এক বছরের ব্যবধানে প্রায় কাছাকাছি আবহ তৈরির চেষ্টা চলছে। তাদের বেশি টার্গেট সচিবালয়ের দিকে। মহড়াটা চলছে আরো আগ থেকেই। গেল ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগে ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় থাকা পাঁচ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর পুড়ে যায়। সরকারি ছুটির দিনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে এখনও জনমনে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। এমন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে সচিবালয়ের নিরাপত্তার দুর্দশার চিত্র সামনে এলো। সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় নিরাপত্তার করুণ অবস্থাও ধরা পড়ছে।
সচিবালয়ে গতিবিধি পর্যবেক্ষণে আছে ৬২৪ সিসি ক্যামেরা। পিলে চমকানো তথ্য হলো, এসব ক্যামেরার মাত্র ৩৫টি এখন সচল। ৯৫টি অর্ধ-বিকল, বাদ বাকি ৪৯৪টি পুরোপুরি অচল। সচিবালয়ের তিন ফটকে আছে চারটি ব্যাগেজ স্ক্যানার। এর সব ক’টিই নষ্ট। এ ছাড়া ছয়টি আর্চওয়ের কোনোটাই কাজ করে না; সবই ‘মৃত’। খোদ সরকারি প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে এমন ভয়ংকর ‘বিকল কাহিনি’। (সমকাল, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫)
বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন যোগ দেন তখন কি তিনি জননিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে কোনো উপাত্ত চেয়েছিলেন? সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি কি কিছুই জানতেন না? সিসি টিভি, আর্চওয়ে ও ব্যাগেজ স্ক্যানারগুলো সচল থাকলে তাদের শনাক্ত করা তেমন দুরূহ হতো না। সচিবালয়ের কর্মকর্তারা সম্ভবত এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধু, ‘কাকের মাংস কাকে খায় না’। তাই তারা দোষীদের চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে না। যদি সিসি টিভি ক্যামেরা চালু থাকত তাহলে সহজেই অপরাধী চক্রকে চিহ্নিত করা যেত।
শেখ হাসিনাকে নির্বাচন নামক ভোট চুরির উৎসবে প্রধান সাহায্যকারী ছিলেন ওই প্রশাসনের কর্মকর্তারা। শীর্ষ থেকে উপজেলা পর্যন্ত প্রত্যেক আমলা বিগত সরকারের লুটপাটের সহযোগী, বেনিফিশিয়ারি। তারা এখনও শেখ হাসিনার কল্যাণকামী। তাদের অপেক্ষা কিছু একটা অঘটনের। আর সাধারণ শিক্ষার্থী ক্রিয়াশীলদের পরিচয়ও এরইমধ্যে পরিষ্কার। বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৩০-এর অধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং শতাধিক আহত-অগ্নিদগ্ধ হওয়ার দুর্যোগ তাদের সুযোগ এনে দিয়েছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ঘৃণ্য খেলার হাতিয়ার করা হয়েছে তাদের। মাইলস্টোন কলেজের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে শিক্ষা সচিব সিআর আবরার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে দিনভর অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের তথ্য গোপনের অভিযোগ, প্রকৃত সংখ্যা তুলে ধরার দাবি, শিক্ষা সচিব ও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ, সকলের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণসহ ৬ দফা দাবিতে মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়ার পর তারা সরকারকে দুর্বল ভাবতে শুরু করে। বহিরাগত বিশেষ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভিড়ে যায় এ স্রোতে। মাইলস্টোন দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে অবরোধসহ ধ্বংসাত্মক তান্ডবে মেতে ওঠে। শিক্ষাসচিবকে প্রত্যাহারের পর তারা আরো আশা দেখতে থাকে। গেট ভেঙ্গে সচিবালয়েই ঢুকে পড়ে। সচিবালয়ের ভেতরে সমানে গাড়ি ভাঙচুর করে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদের মধ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ছবি ধরা পড়ে। মাইলস্টোন কলেজে নিহতদের লাশ গুম করার গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সংক্ষুব্ধ করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নেপথ্যে নেতৃত্ব দিয়ে সচিবালয়, মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ গড়ে তোলে। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী অস্থিতিশীল সময়ে ছাত্রলীগসহ পতিত সরকারের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা লোটার নানাবিধ অপচেষ্টা চালিয়েছে। টার্গেট ছিল আরো অনেক কিছু করার। শেষ পর্যন্ত তা পারেনি। এর আগে, গত বছর সেপ্টেম্বরে আনসারদের সংগঠিত করে সচিবালয় দখলেরও চেষ্টা করেছে। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অচলাবস্থা থাকলেও ছাত্র-জনতার ঐকবদ্ধ প্রতিরোধে তাদের প্রতিটি অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে।
এবার বিমান দুর্ঘটনায় হতাহত শিশু-কিশোর ও শিক্ষকদের বিয়োগান্তক ঘটনার সময় যখন সকলকে ঐকবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় উদ্ধার অভিযান চলছিল, নিহতদের দাফন, বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টরা হিমসিম খাচ্ছে, শত শত মানুষ হাসপাতালে রক্ত দান করতে ভিড় করছে, তখন এরা উল্লাস নৃত্য করছে। নেমেছে গুপ্তঘাতকের ভূমিকায়। বিমান দুর্ঘটনায় বিয়োগান্তক ঘটনা তাদের পুঁজি। মে মাসে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে ঘিরেও মাঠে নেমেছিল তারা। তবে তত সুবিধা করতে পারেনি। নমুনা বলছে, এরা হাল ছাড়বে না। যখন যে ইস্যুতে সুযোগ পাবে তা কাজে লাগাবে। লক্ষণ সে রকমই। এর বিপরীতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এক বছরে ভালো অভিজ্ঞতা কম, খারাপ অভিজ্ঞতাই বেশি।
অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সরকারের মধ্যে সক্ষমতার অভাব আর লুকানোর মতো নয়। আবার বৈষম্যহীন যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সেখানেও বেশ বিপত্তি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে যেসব কাজ দরকারি ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্মে তার ছাপ কম। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মাঝেও মারাত্মক বিভাজন। তারা কোনোভাবেই নতুন কোনো পথের পথিক হতে চায় না। নতুন বন্দোবস্তের আওয়াজ তোলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের মাঝেও পুরনো পথেই ঘোরাফেরা। তাদের মধ্যে নির্বাচনকে খাটো করার প্রবণতা। গণতন্ত্র চান, কিন্তু নির্বাচন চান না। নির্বাচনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার বা নির্বাচনকে বিলম্বিত করার একটা চেষ্টা আছে। দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে বেশ কিছু শক্তির নড়াচড়াও দেখা যাচ্ছে।
নৈরাজ্যকর অবস্থার প্রত্যাশীমহলও আছে। মুখ নানান উচ্চাশা থাকলেও বাংলাদেশ রাতারাতি পাল্টে যাবে, তা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। দীর্ঘদিনের একটা চর্চা ও সংস্কৃতির বিষয় রয়েছে। তাই বলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে? তাহলে পুরো জাতি কেন এক স্বৈরাচারী সরকার ও মাফিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল? আন্দোলনকালে সৃষ্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ছিল একমাত্র ব্যানার, যার ডাকে সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, জীবন দিয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নতুন দলও প্রত্যাশার তুলনায় নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারেনি। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি, এই তিন দলের মধ্যে এখন নিত্যকলহ লেগে আছে। তবে শেষের দুই দলের কলহের তুলনায় সদ্ভাব বেশি। আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাধারণ অনেক পক্ষই যার যার পুরোনো অবস্থায় ফিরে গেছে।
এছাড়া, কোনো কোনো পক্ষকে রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের মাঠ থেকে কৌশলে বা পরিস্থিতি তৈরি করে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যেমন নারীরা আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকলেও কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বড় অবদান থাকলেও তরুণদের নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক শক্তিতে, ঢাকাকেন্দ্রিক পুরুষ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেকদের প্রাধান্য। সারকথা হলো, আন্দোলন সবার থাকলেও আন্দোলন-পরবর্তী এক বছর কারও কারও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ সুযোগটাই কাজে লাগাতে চায় পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।