ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে গণ্য করা যায়। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশের জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় চব্বিশের জুলাইয়ে সর্বাত্মক গণপ্রতিরোধের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সেই অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট হিসেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে একটি সুষ্ঠ, অবাধ জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। কিন্ত অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও নির্বাচন অহেতুক বিলম্বিত করার আশঙ্কা জনমনে ডালপালা বিস্তার করছিল। যদিও প্রধান উপদেষ্টা শুরু থেকেই ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব হস্তান্তরের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। তবে তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের কোনো কোনো প্রভাবশালী সদস্যের ভূমিকা দেখা গেছে অস্বচ্ছ। এনজিও এবং এক সময়ের জাসদের ভাবধারা প্রভাবিত উপদেষ্টাদের ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে ও জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছিল। তারা প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির উপর যেন ভরসা রাখতে পারছিলেন না। এসব উপদেষ্টা যেন জনপ্রত্যাশা পুরণের চেয়ে ক্ষমতা ভোগ করতেই বেশি আগ্রহী। একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যেও নির্বাচন অনির্ধারিত বিলম্বে হোক, এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত হতে দেখা গেছে। নান রকম জল্পনার মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষিত না হওয়ার কারণে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা ও সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছিল। ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে অর্থাৎ রমজানের আগেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টার এই সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারি ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাঁর এই সিদ্ধান্ত ও মহতি প্রত্যাশাকে আমরা স্বাগত জানাই।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সরকারের এক বছরের কর্মকান্ডের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। বিশেষত একটি ভঙ্গুর অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চারের যে বার্তা তিনি দিয়েছেন তা খুবই আশাব্যঞ্জক। মূল্যস্ফীতি, রেমিটেন্স ও রিজার্ভ নিয়েও ইতিবাচক পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেছেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন আগামী জাতীয় নির্বাচনের উপর। এই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও ঈদের মত উৎসবমুখর করে বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সামনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি পুর্নব্যক্ত করেছেন। তিনি বরাবরের মত রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নতুন প্রজন্মের সাহসী ও প্রত্যয়দীপ্ত ভূমিকা ও অংশগ্রহণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তবে ইতিপূর্বে তিনি তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানালেও এবার তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের ক্লাশে ফিরে গিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার আগে প্রধান উপদেষ্টা দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিয়ে লাখো জনতার সামনে জাতীয় সংসদ ভবন চত্বর-মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জুলাই সনদের ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন। সংস্কার কমিশনগুলোর মাধ্যমে গত এক বছরে যে সব সংস্কার প্রস্তাব চুড়ান্ত হয়েছে এবং শেষের পথে রয়েছে তারই একটি স্বচ্ছ ধারনা উপস্থাপন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। জুলাই সনদে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং পতিত ফ্যাসিবাদি রিজিমের কুশীলবদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ও পার্লামেন্টের উপর অর্পিত হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বাস্তবতায় আগামী সংসদের উপর জাতির প্রত্যাশার এক গুরু দায়িত্ব অর্পিত হতে চলেছে। বিশেষত পিআর পদ্ধতির নির্বাচন এবং দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে জনমত যাচাইয়ের সুযোগ লাভ করবে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচন সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো এখন থেকেই প্রার্থী বাছাই, জনমত যাচাই এবং নির্বাচনে নিজ নিজ পক্ষে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নেমে পড়তে হবে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের উপর অহেতুক চাপসৃষ্টি এবং সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর হবে বলে আশা করা যায়।

বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি, সংসদ ও সরকার গঠনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক গতিশীলতা, সাংবিধানিক নিরপেক্ষতা ও কর্মক্ষমতা ভেঙ্গে পড়েছে। বিশেষত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশের চেইন অব কমান্ড এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচারি রিজিমের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে পলতক বা আত্মগোপণে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে তাদের অতীত কর্মকান্ডের জন্য কোনো অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না। উপরন্ত তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানা রকম উস্কানিমূলক কর্মকান্ড ও কর্মসূচির নির্দেশনা দিচ্ছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন, রদবদল, জনবল বৃদ্ধি ও জরুরি প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ১৬ বছরের ধ্বংসযজ্ঞ ও বিশৃঙ্খলা থেকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাতারাতি পরিবর্তিত সক্ষমতার ধারায় প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা কিছু করনীয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারকে এখন সেদিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। কোনো কুচক্রিমহল যেন নির্বাচনের তারিখ পেছানোর অজুহাত দেখাতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রায় চারকোটি নতুন ভোটার, যারা গত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি, এবারের নির্বাচনে তাদের ভূমিকাই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। যে তারুণ্য জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করে নতুন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, এই স্বাধীনতার সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারি ঘটনা হবে তারুণ্যের ভোট উৎসবকে ঈদ উৎসবে পরিনত করা। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য টাইমলাইন ঘোষণার মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অর্ন্তবর্তী সরকার দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় উত্তরণের পথচলা সনির্দিষ্ট করেছে।এর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে ড.মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সরকার ইতিহাসের অংশে পরিনত হবে, সঙ্গত কারণেই তা আশা করা যায়। প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনূসের প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা।

সূত্র, কালের কন্ঠ