যেমন-একদা চুরির দায়ে অভিযুক্ত এক নেতাকে শাস্তিস্বরূপ সমুদ্রের পানিতে ডুবাইয়া মারিবার প্রস্তাব উঠিলে জনগণ হায় হায় করিয়া বলিয়া উঠে, তাহাতে সমুদ্র আইনে শাস্তি হইতে পারে! উপস্থিত অনেকে ইহার কারণ জানিতে চাহিলে ভিড়ের মধ্য হইতে কোনো একজন বলিয়া উঠেন, 'এই নেতা চোর ছিল; তাহাকে সমুদ্রে চুবাইলে পানি দূষিত হইবে বিধায় পরিবেশ দূষণের দায়ে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনিতে হইতে পারে!' কোনো একদিন সেই দেশেরই জাতীয় সংসদের গেটের সামনে ভাঙাচোরা একটি সাইকেলে তালা মারিয়া রাখিতেছিল এক ব্যক্তি, যাহা দেখিয়া নিরাপত্তারক্ষীরা ছুটিয়া আসিয়া ধমকের সুরে লোকটিকে বলিল, 'ঐ ব্যাটা, এইখানে সাইকেল রাখিতেছিস কী বুঝিয়া-শুনিয়া? জানিস না, এই পথ দিয়া মন্ত্রী-মিনিস্টাররা যাতায়াত করেন!' বলা বাহুল্য, লোকটি গালভরা হাসিমুখে জবাব দিয়াছিল- 'কোনো সমস্যা নাই ভাইজান, সাইকেলে তালা মারিয়া দিয়াছি!'

যেই সমাজের এহেন দশা, সেইখানে আসলে কী এমন ঘটে যে, যাহার কারণে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে জনমনে এইরূপ ধারণা ঢুকিয়া যায়। ইহার কারণ জানা যায় অন্য একটি কৌতুকে; কৌতুকটি এমন যে, এক দেশের অর্থমন্ত্রী প্রথম দিন মন্ত্রণালয়ে আসিয়া দেখিলেন, তাহার টেবিলের উপর পূর্বের অর্থমন্ত্রী একটি চিরকুট আর তিনটি খাম রাখিয়া গিয়াছেন; চিরকুটে লেখা রহিয়াছে, 'যখনই কোনো সমস্যা হইবে, একটি করিয়া খাম খুলিবেন এবং তাহাতে যাহা নির্দেশ দেওয়া আছে, তাহা পালন করিতে থাকিবেন। ইহাতে নিমেষেই মুশকিল আসান হইয়া যাইবে!' প্রথম বছরেই দেখা গেল ভয়াবহ অর্থসংকটে পড়িলেন মন্ত্রী-কিছুতেই বাজেট মিলিতেছে না। শেষমেশ একটি খাম খুলিলেন, যাহাতে লেখা ছিল, 'পূর্বের সরকারকে ইচ্ছামতো গালি দিন।' যেই কথা সেই কাজ! তিনি তাহাই করিলেন। কী আশ্চর্যের ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়া গেল! পরের দুই বছরে বাজেট লইয়া একইভাবে ঝামেলায় পড়িলে খুলিলেন দ্বিতীয় খামটি, যাহাতে লেখা, 'পূর্বের সরকারের সকল পরিকল্পনা বাতিল করিয়া দিন।' যথারীতি মন্ত্রী তাহাই করিলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে এইবারও তিনি সমস্যা দিব্যি উতরাইয়া গেলেন। এইভাবে তৃতীয় বছরে সংকট যখন আরো ঘনীভূত হইতে থাকিল, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তিন নম্বর খামটি খুলিলেন এবং দেখিলেন তাহাতে লেখা, 'এইবার পদত্যাগ করুন এবং হুবহু তিনটি খাম তৈরি করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া বিদায় হউন।'

প্রকৃতপক্ষে কতিপয় উন্নয়নশীল দেশে যেন এইরূপ অবস্থায় পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। সেইখানে এক চোর বিদায় নেয়, তো আরেক চোরের উদয় ঘটে। তাহারা জনগণের উপকার করিতে আসিয়া কেবল পূর্বের সরকারের আমলনামার ফিরিস্তি লইয়াই পড়িয়া থাকে। পূর্বের সরকার কী কী অপকর্ম করিয়াছে, কোথা হইতে কত টাকা পকেটে পুরিয়াছে, কেবল সেই সকল হিসাবনিকাশই চলিতে থাকে। অথচ তিনিও সেই পূর্বেকার নেতার মতোই প্রতিশ্রুতির বাণী দিয়া চেয়ারে বসেন এবং ইহার পর ভুলিয়া যান নিজের দায়দায়িত্বের কথা। ইহাই উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতির নিয়মিত চেহারা।

বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সরকার বা নেতারা যাহা করেন, যেই ল্যাংগুয়েজে কথা বলেন, তাহা দেখিয়া সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, তাহারাও পূর্বেকার নেতা বা রাজনীতিবিদদেরই পথ ধরিয়া হাঁটিতেছেন। অনুরূপভাবে একসময় যাহাদের বিরুদ্ধে চুরি-চামারিসহ বৃহৎ অভিযোগের স্তূপ ছিল, তাহারাও ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে মরিয়া হইয়া উঠেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতাদের যেন উদ্দেশ্য এবং বিধেয় একই-'চুরি'। কৌতুকে পাওয়া যায়, এই চিত্র দেখিয়া একবার ধন্দে পড়িয়া যান এক পরিব্রাজক; তাহা হইলে উন্নয়নশীল দেশসমূহ আদতে কে বা কাহারা পরিচালনা করেন-এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে থাকেন। কোনো কূলকিনারা না পাইয়া শেষ পর্যন্ত ধর্মচর্চায় মনোনিবেশ করা শুরু করেন। সকলেই ইহার কারণ জানিতে চাহিলে তিনি জবাব দেন, 'ঈশ্বর যদি নাই থাকিবেন, তাহা হইলে ঐ দেশটি চালাইতেছে কে?

সূত্র, ইত্তেফাক