প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হলে সব অংশীজনকে আস্থায় নিয়ে করতে হয়। এর ইতি-নেতি প্রতিক্রিয়া আগে থেকে চিন্তা করতে হয়। অন্যথায় যে হযবরল হওয়ার উপক্রম হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান অচলাবস্থাই তার প্রমাণ। শনিবার পর্যন্ত সেখানকার কর্মকর্তারা কর্মবিরতি পালন করে আসছিলেন। আজ রোববার থেকে কমপ্লিট শাটডাউনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যে প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ অর্থ আদায়ের উৎস, সেই প্রতিষ্ঠানে এ রকম অচলাবস্থা কখনো কাম্য হতে পারে না।

এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি বিভাগ করে ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর পর থেকে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করে আসছেন। এর ফলে জনগণ যেমন সেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, তেমনি রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুল্ক-কর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ সংশোধন করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তারা বলেছে, যেহেতু অধ্যাদেশটি প্রয়োজনীয় সংশোধন করে বাস্তবায়ন করার কাজটি অনেক সময়সাপেক্ষ, এনবিআরের সব কার্যক্রম আগের মতো অব্যাহত থাকবে এবং কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদ্যমান ব্যবস্থায় সব কার্যক্রম সম্পাদন করবেন।

সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তাঁরা কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন। তঁাদের অভিযোগ, যাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তঁারা রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি ভালো বোঝেন। তারপরও সরকার প্রশাসন ক্যাডারের ব্যক্তিদের এখানে এনে ঊর্ধ্বতন পদে বসাচ্ছে। এনবিআরের সদস্যদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা করা হয়নি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই সব সময় এই পদে অধিষ্ঠিত হন।

সরকারের স্পষ্ট ঘোষণার পর এনবিআর কর্মকর্তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে এনবিআর কর্মকর্তাদের অভিযোগ, দুটি পৃথক অবকাঠামো গঠিত হলে প্রশাসন ক্যাডারের দাপট আরও বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় রাজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চাকরি থাকলেও কর্তৃত্ব থাকবে না।

সরকারের দাবি, এনবিআরের পুনর্গঠন শুধু আমলাতান্ত্রিক রদবদল নয়; এটি ন্যায্য, উন্নত ও সক্ষম করব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা যত মহৎ হোক না কেন, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের আস্থায় না আনতে পারলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

সরকার রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে এনবিআর ভেঙে দুটি প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছে। গত পাঁচ দশকে কখনো রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এর জন্য কেবল কাঠামোগত দুর্বলতা নয়, নীতিগত অস্বচ্ছতাও দায়ী। এনবিআর ভেঙে দুটি প্রতিষ্ঠান করলেই সরকারের রাজস্ব বাড়বে তার নিশ্চয়তা কী? সরকার মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি কমানোর কথা বলছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব হবে, যখন উচ্চ পদাধিকারীরা স্বচ্ছতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। এনবিআরে মতিউর–কাণ্ড বন্ধ করতে হলে কেবল কাঠামোগত সংস্কার নয়, নীতিগত সংস্কার জরুরি বলে মনে করি।

এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে’। বাস্তবে সেটি হয়নি। বরং এনবিআর কর্মকর্তাদের দাবিনামায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের পদত্যাগও যুক্ত হয়েছে। এনবিআরের মতো অতি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে এই অচলাবস্থা চলতে পারে না। ভুল–বোঝাবুঝির অবসানে প্রয়োজনে আবারও আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসুন।

সূত্র, প্রথম আলো