কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া সব হিন্দু দল ও সংগঠন এবং কংগ্রেস বাংলা ভাগের দাবি করেছে। ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত মতে, ভাইসরয় এডমিরাল লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ করেছেন।
ব্রিটিশ ভারতে সবচেয়ে বড় প্রদেশ ছিল বাংলা। এই প্রেসিডেন্সির পূর্ব থেকে পশ্চিম সীমানার দূরত্ব ৮০০ মাইলের মতো। তাই ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও প্রশাসনিক সুবিধার্থে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৬ বর্গমাইলের বিশাল আয়তনের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি পৃথক করে নতুন একটি প্রদেশ গঠনের ব্রিটিশ সরকারের একটি খসড়া প্রস্তাব ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
গেজেটে প্রকাশিত প্রস্তাব সামনে রেখে ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি নবাব খাজা সলিমুল্লাহর আহ্বানে ও সভাপতিত্বে আহসান মঞ্জিলে মুসলমানদের এক মতবিনিময় সভা হয়। সভাপতির ভাষণে নবাব সলিমুল্লাহ ১৮৭৪ সালের ১২ অক্টোবর গঠিত আসাম প্রদেশ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিভাগ এবং দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহারসহ প্রেসিডেন্সি বিভাগের যশোর ও খুলনা জিলা দু’টির সমন্বয়ে ব্যবস্থাপক সভা গভর্নর শাসিত একটি নতুন প্রদেশ গঠন এবং ঢাকাকে নতুন প্রদেশের রাজধানী করার প্রস্তাব দেন।
পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সামাজিক নেতা ও পরম্পরা নবাবের প্রস্তাব আমলে নিয়ে লর্ড কার্জন নতুন প্রদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভব করেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯০৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে, ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এবং ২০ ফেব্রুয়ারি মোমেনশাহীতে জনসভায় লর্ড কার্জন উন্নততর জীবনযাপনে নতুন প্রদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন। ঢাকা সফরকালে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য লর্ড কার্জন নবাব বাড়ি আহসান মঞ্জিলের মেহমান হন। এ সময় নতুন প্রদেশ কার্যকর করা নিয়ে নবারের সাথে লর্ড কার্জন একান্তে আলোচনা করেন। নবাব সলিমুল্লাহ নিজের বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে আহসান মঞ্জিলের মাঠে লর্ড কার্জনের সম্মানে এক জমকালো সংবর্ধনার আয়োজন করেন। ওই সংবর্ধনায় উপস্থিত হাজার হাজার শ্রোতার কাছে ভাইসরয় নতুন প্রদেশের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেন।
ব্রিটিশ রাজা (১৯০১-১৯১০) সপ্তম এডওয়ার্ডের কাছ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে ভাইসরয় লর্ড জর্জ ন্যাথালিয়েন কার্জন বঙ্গভঙ্গ করে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। নতুন প্রদেশের রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দরনগরী। অখণ্ড বাংলার ১৪টি জিলা ও দু’টি দেশীয় রাজ্য নতুন প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেগুলো হলো : বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, ঢাকা, মোমেনশাহী, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, পার্বত্য ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম এবং ১৮৭৪ সালের ১২ অক্টোবর ১০টি জিলা নিয়ে গঠিত আসাম প্রদেশ। পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের সীমানা এমনভাবে চিহ্নিত হয়, যার ফলে হিন্দি ভাষী কোনো এলাকা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নতুন প্রদেশের আয়তন এক লাখ ছয় হাজার ৫৪০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা তিন কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে এক কোটি ৮০ লাখ মুসলিম এবং এক কোটি ২০ লাখ হিন্দু আর বাকি ১০ লাখ বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন প্রদেশের প্রথম গভর্নর তদানীন্তন আসাম প্রদেশের চিফ কমিশনার র্যামফিল্ড ফুলার যিনি নতুন প্রদেশের একজন ঘোর সমর্থক ছিলেন।
শুরু থেকে বাংলার বর্ণবাদী হিন্দুরা তীব্রভাবে নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কলকাতা প্রবাসী পূর্ব বঙ্গের জমিদার, ভূ-স্বামী, জোতদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী তাদের কায়েমি স্বার্থে জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলেন। বঙ্গভঙ্গের দিন ১৬ অক্টোবর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে কলকাতায় পালিত হয় ধর্মঘট এবং গঙ্গা¯œান, কালীপূজা ও রাখী বন্ধন কর্মসূচি। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অখণ্ড বাংলার জন্য রচিত বেশ কয়টি গান এ সময় গীত হয়। এর মধ্যে ১৯০৫ সালের ৭ অক্টোবর কলকাতার টাউন হলের প্রতিবাদ সভায় প্রথম গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি অন্যতম যা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এ সময় বিলাতি পণ্য বর্জনের নামে গড়ে উঠে স্বদেশী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিশিষ্ট কয়েকজন হিন্দু জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯০৬ সালে চালু হয় শিবাজী উৎসব। গড়ে তোলা হয় কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন।
উপমহাদেশে বোমাবাজির মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় কলকাতা থেকে যা পরবর্তীতে সুস্থ রাজনীতিকে কলুষিত করে। ১৯০৬ সালের ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর দাদাভাই নওরোজীর সভাপতিত্বে এবং কংগ্রেসের নজরকাড়া তরুণ নেতা ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অংশগ্রহণে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ২২তম অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গবিরোধী প্রস্তাব গৃহীত হলে তা সর্বভারতীয় বিরোধিতায় পরিণত হয়। তাদের এ আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ রহিত করার লক্ষ্যে, কোনোভাবে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী ছিল না।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারত কী করে ভাগ হলো গ্রন্থে বিমলানন্দ শাসমল সত্য প্রকাশ করে বলেছেন : ‘বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলিমবিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এ আন্দোলনের তাগিদে যেসব সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিত হলেন, তারা সবাই ছিলেন গভীরভাবে মুসলমানবিরোধী।’ বঙ্গভঙ্গ করে নতুন প্রদেশ গঠন করার পর পূর্ব বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত ও হতদরিদ্র ভূমিদাস মুসলিমদের সামনে সর্বক্ষেত্রে ভাগ্যোন্নয়নের শত বছরের রুদ্ধ কপাট খুলে যায়। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে হিন্দু জমিদার ও সমাজপতিরা মুসলমানদের উন্নতি ঠেকাতে নতুন প্রদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। ১৮১৩ সালে সিলেক্ট কমিটিতে স্যার জন ম্যালকম বলেছিলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের আনুগত্য আমাদের ভারত সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার প্রধান উৎস।’
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার সমাজপতি ও বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন মোকাবেলা করার মতো অনুরূপ ঐক্য পূর্ব বঙ্গের পশ্চাৎপদ ও অসচেতন মুসলিমদের মধ্যে ছিল না। ফলে নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন প্রদেশের পক্ষে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম নেতাদের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা নির্ভুলভাবে উপলব্ধি করেন। তাই তিনি ১৯০৬ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর নতুন রাজধানী ঢাকায় নিজ খরচে আয়োজন করেন ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের’ ২০তম অধিবেশন। এ ঐতিহাসিক অধিবেশন সফল করতে তার সার্বক্ষণিক সহকর্মী ছিলেন নবাবের ব্রেইন চাইল্ড নামে খ্যাত তরুণ আইনজীবী এ কে ফজলুল হক। সর্বভারত থেকে ঢাকায় আগত ২৪২৩ বিশিষ্ট মুসলিম প্রতিনিধির ছয়দিন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন মেজবান নবাব। অধিবেশন শেষে নবাবের অনুরোধে ৩০ ডিসেম্বর এক বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ইংরেজিতে প্রদত্ত দীর্ঘ ভাষণে নবাব সলিমুল্লাহ পরাধীন ভারতের মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষাসহ জাতিসত্তার চেতনায় তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার পর ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত নবাবদের ইশারাত মনজিলের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন) ময়দানে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। নব গঠিত দলের আহ্বায়ক পদে নবাব ভিকারুল মুলক মোশতাক হোসাইন বাহাদুর এবং সদস্য সচিব পদে নবাব মহসিন-উল-মুলক মেহেদী আলী খান নির্বাচিত হন।
১৯০৮ সালের ৯ আগস্ট আলীগড়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সভায় ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলে মুসলিম প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত, মুসলিম বিচারপতি নিয়োগ করে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় স্বতন্ত্র হাইকোর্ট স্থাপনের দাবিসহ বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে প্রস্তাব নেয়া হয়। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রতি সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের কার্যকর সমর্থন ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে তরুণ নবাব খাজা সলিমুল্লাহর দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়। তার উদ্যোগে ও একক অর্থায়নে ১৯০৬ সালে ঢাকায় গঠিত মুসলিম লীগের আদর্শিক পতাকা নিয়ে মুসলিমরা ১৯০৭ সালে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ পান। ফলে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের ২১ বছরের একক কর্তৃত্ব ও একচ্ছত্র আধিপত্য হ্রাস পায়।
আমাদের পূর্বপুরুষের লুণ্ঠিত অধিকার পুনরুদ্ধারের গৌরব নিয়ে মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতকে বিভক্ত করে দু’টি প্রদেশের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে।
পলাশী যুদ্ধোত্তর ১৪৯ বছর ধরে হিন্দুদের আনুগত্য ও সহযোগিতায় ভর করে ব্রিটিশরা বাংলা ও ভারত লুণ্ঠন এবং শাসন করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই সম্প্রদায়ের আনুগত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ নিয়ে পুনরায় ভাবতে থাকে। ‘ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করলে বাংলার হিন্দু নেতারা তা মেনে নিলে রাজা পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রহিত করে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশ বিলুপ্ত করবেন’ ভাইসরয় লর্ড ব্যারন হার্ডিঞ্জের কাছ থেকে এমন সুস্পষ্ট বার্তা পেয়ে উল্লসিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা পঞ্চম জর্জকে ভারতের ভগবান বা ভাগ্য বিধাতার চেয়ার অধিষ্ঠিত করে লিখলেন : ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা’ গানটি যা ব্রিটিশ রাজার উদ্দেশে প্রথম গীত হয় ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবার হলে। ভাইসরয়ের বক্তৃতার পর রাজা হঠাৎ ঘোষণা করলেন, ‘ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করা হবে। বঙ্গভঙ্গ রহিত করা হলো।’ এ ঘোষণা শুনে দরবার হলে উপস্থিত নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ও অন্যান্য মুসলিম নেতা হতবাক হলেন। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারলেন না, কারণ শাসনতান্ত্রিক বিধানে রাজার উক্তির বিরুদ্ধে কারো পক্ষে কোনো আপত্তি উত্থাপনের অধিকার ছিল না।
অনুগত হিন্দু সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট রাখতে বঙ্গভঙ্গ রহিত করে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চাৎপদ মুসলমানদের আবার অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিতে ব্রিটিশরাজ সে দিন কুণ্ঠাবোধ করেননি।
বঙ্গভঙ্গ রহিত করায় নতুন প্রদেশ বিলুপ্ত হয়। কলকাতা আবার অখণ্ড বাংলার রাজধানী হওয়ার পর ঢাকা আবার জিলা শহরে পরিণত হয়; যা ছিল ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত। নতুন প্রদেশটি বিলুপ্ত করার পর থেকে হতাশায় নবাব সলিমুল্লাহ শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বাংলার মুসলমানদের একমাত্র নেতা ও তাদের রাজনীতি ও শিক্ষা বিস্তারের পথ প্রদর্শক দানবীর নবাব সলিমুল্লাহ কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের নিজ বাসভবনে ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ৪৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দাফনের জন্য নবাবকে ঢাকায় আনার পর ব্রিটিশ সরকার লাশ দেখার অনুমতি দেয়নি তার আত্মীয়স্বজন ও ঢাকাবাসীকে। সৈন্যরা বেগম বাজারস্থ তার কবরটি ছয় মাস পাহারা দিয়ে রাখে। তাতে অনুমতি হয় যে, নবাবকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। নবাবের মৃত্যুর পর পূর্ব বঙ্গের আশাহত মুসলিমরা উপলব্ধি করেন, মুসলিম লীগের মাধ্যমে অধিকার আদায় করতে না পারলে হিন্দুদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে বাঁচতে হবে। ফলে জাতিসত্তার চেতনা নিয়ে আমাদের মুক্তিপাগল পূর্বপুরুষ ২৬ বছর পর ১৯৩৭ সালে অঙ্কুরোদগম ঘটান স্বাধীন রাষ্ট্রের সম্ভাবনার বীজ। ১৯৩৭ সালে নির্বাচিত হয়ে মুসলমানরা পুনরায় বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হয়। প্রথম মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক, দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী (১৯৪৩-৪৬) খাজা নাজিমউদ্দিন এবং তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী (১৯৪৬-৪৭) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো মুসলিম লীগের তিন কিংবদন্তীসম নেতা অখণ্ড বাংলার শাসন পরিচালনার গৌরব অর্জন করেন।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। ফলে মুসলিমবিদ্বেষী কলকাতার বর্ণবাদী হিন্দু নেতারা নিশ্চিত হন যে, মুসলিম লীগের প্রস্তাব গ্রহণ করে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠন করলে বাংলায় মুসলিম শাসন স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে বাংলা ভাগ করতে তারা তৎপর হন। বাংলা ভাগ অনিবার্য করতে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা কলকাতায় তিন দিনব্যাপী ভয়াবহ দাঙ্গা বাধায়। দাঙ্গায় ১০ হাজারো মুসলিম নিহত হন। এ দাঙ্গা ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং নামে’ ইতিহাসে অভিহিত। এইচ ভি হাডসন তার দ্য গ্রেট ডিভাইড গ্রন্থে, আয়ান স্টিফেন পাকিস্তান গ্রন্থে, কলিন্স ও লেপিয়ার তাদের ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট গ্রন্থে ক্যালকাটা কিলিংয়ের গা শিউরে ওঠা বর্ণনা দিয়েছেন।
১৯৪৭ সালের ৮ মার্চ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ১৬ মার্চ দিনাজপুরে মুসলিম লীগের জনসভায় স্পিকার নূরুল আমিন বলেন : অখণ্ড বাংলা হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ২২ এপ্রিল সাবেক মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বলেন, বাংলা ভাগ করলে তা হবে বাঙালির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ২২ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ হবে পশ্চিম ভারতের কলোনি। ১ মে মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ বলেন, বাংলা ভাগের দাবি বিদ্বেষপূর্ণ ও দুরভিসন্ধিমূলক।
৫ মে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কলকাতার ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাসভবনের সভায় হিন্দু মুসলিম নেতাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলার খসড়া সংবিধান রচনায় হোসেন শাহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমউদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, ফজলুর রহমান, পণ্ডিত আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বোস, কিরণ শংকর রায়, নলিনী রঞ্জন সরকার ও সত্যরঞ্জন বকশী সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
সুভাষ চন্দ্র বোসের অগ্রজ, ফরোয়ার্ড ব্লক ও কংগ্রেস নেতা শথরৎচন্দ্র বোসের ১ নম্বর উডভার্ন পার্কের বাসায় ২০ মের সভায় স্বাধীন বাংলার খসড়া সংবিধান ও একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন পণ্ডিত আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বোস। বিষয়টি জানিয়ে শরৎচন্দ্র বোস ২৩ মে গান্ধীকে একটি চিঠি পাঠান। প্রতি উত্তরে শরৎচন্দ্র বোসকে তিরস্কার করে ২৩ জুন কংগ্রেস নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী লিখেন, ‘তোমার উচিত হবে অখণ্ড বাংলার জন্য সংগ্রাম ত্যাগ করা এবং বাংলার বিভক্তির জন্য যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করা।’
এইচ বি হাডসন তার দ্য গ্রেট ডিভাইড গ্রন্থের ২৪৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘২৩ এপ্রিল পাঞ্জাব নিয়ে আলাপকালে মাউন্ট ব্যাটেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে জিন্নাহকে বললেন, সোহরাওয়ার্দী ও তার বন্ধুরা স্বাধীন বাংলা গঠনের চেষ্টা করছেন। অখণ্ড স্বাধীন বাংলার ব্যাপারে আপনার মত কী? অবশ্য স্বাধীন বাংলা পাকিস্তানের বাইরে থাকবে।’ জিন্নাহ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘বাংলা স্বাধীন হলে আমি খুশি হবো। কলকাতা ছাড়া বাংলার মূল্য নেই। তারা যদি একত্র হয়ে স্বাধীন বাংলা গঠন করেন, তাহলে নিশ্চয় আমাদের সাথে তারা সদ্ভাব রাখবেন।’ মুসলিম লীগের সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খান স্বাধীন বাংলার পক্ষে ছিলেন। বিক্রমাদিত্য তার স্বাধীনতার অজানা কথা গ্রন্থে বলেছেন, ‘জিন্নাহ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেছিলেন যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে তিনি অখণ্ড রাখতে পারবেন এবং বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।’
কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া সব হিন্দু দল ও সংগঠন এবং কংগ্রেস বাংলা ভাগের দাবি করেছে। ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত মতে, ভাইসরয় এডমিরাল লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ করেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে ১৯১১ সালে যেমন বঙ্গভঙ্গ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি; তেমনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেও মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাংলার বিভক্তি ঠেকাতে পারেনি। বঙ্গমাতার অঙ্গহানি করা হয়েছে বলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে যেসব বিপ্লবী যুবনেতা রাজধানীর বিনিময়ে বঙ্গভঙ্গ রহিত করেছিলেন, সেই তারাই ৩৫ বছর পর তাদের বঙ্গমাতাকে বলি দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করেন।
লেখক : স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ