মাদক হলো নেশা উদ্রেককারী বস্তু, যা মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে দেয়, যার প্রভাবে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করে না। ধর্মে সব ধরনের মাদক বা নেশাদ্রব্য হারাম করা হয়েছে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক সুরক্ষার জন্য। মাদক এমন একটি ধ্বংসাত্মক উপাদান, যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এবং স্বাভাবিক জীবনধারাকে বিপর্যস্ত করে। মাদক আজ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি সমাজের সব স্তরে প্রভাব ফেলছে, বিশেষত যুব সমাজকে বিপথগামী করছে। মাদক মানব সমাজের প্রাচীনতম ক্ষতগুলোর একটি, যা সমাজে নানা অনাচার ও অপরাধের অন্যতম কারণ। বর্তমান পৃথিবীতে যত জটিল ও মারাত্মক সমস্যা রয়েছে তন্মধ্যে মাদক দ্রব্য আর মাদকাসক্তি সবার শীর্ষে। মাদকের ভয়ংকর থাবায় আজ বিশ^ব্যাপী বিপন্ন মানবসভ্যতা। এর সর্বনাশা মরণ ছোবলে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভেঙ্গে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। বিঘিœত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বৃদ্ধি পাচ্ছে চোরাচালানসহ মানবতাবিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ। মাদকাসক্তির কারনে সকল জনপদেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাস বেড়ে গিয়ে মানুষের জানমাল আর নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। মূলত সমাজের অধিকাংশ অপরাধের জন্য মুখ্যভাবে দায়ী এই মাদকতা। মাদক সেবন আত্মার পরিশুদ্ধি ও শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্য যেসব নিষিদ্ধ বিষয় রয়েছে, সেগুলো থেকে ব্যক্তি চাইলে সহজেই বিরত থাকতে পারে। অর্থাৎ, ইচ্ছা করলে এসব অপরাধ থেকে সরে থাকা যায়। কিন্তু, মাদক গ্রহণ এমন এক অপরাধ, যা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; বরং মাদকসেবী নিজেই মাদক বা নেশার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। চাইলেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হয় না।Real estate

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম। ইসলাম ধর্মে মাদকাসক্ত বিষয়ে কী উল্লেখ রয়েছে, তা কোরআন এবং সহি হাদিসের আলোকে আলোকপাত করার প্রচেষ্টা থাকবে এ প্রবন্ধে। কারণ মোট ৯০% অর্থাৎ সংখ্যা গুরু জনসংখ্যা মাদকমুক্ত হলে বাকি সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ও মাদকমুক্ত হতে উৎসাহ পাবে। চিকিৎসা বিজ্ঞান কখনো পুরানো পঁচা বিশ্রী ও কেমিক্যাল জাতীয় দ্রব্য ভক্ষণ করাকে উৎসাহ প্রদান করে না। মদসহ সকল মাদক পঁচা, বিশ্রী, নোংরা, কেমিক্যাল ও দুর্গন্ধযুক্ত দ্রব্য দিয়ে তৈরি।

পৃথিবীর অধিকাংশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মনগড়াভাবে তত্ত্ব বানিয়ে মাদকসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের প্রয়াস গ্রহণ করে থাকে। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে সৃষ্টি করে সকল সমস্যার সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন। কুরআনকে জ্ঞানীদের পথপ্রদর্শক হিসেবে আল্লাহ নাযিল করেছেন। ব্যক্তি একটি গাড়ি বা বিমান ইঞ্জিন তৈরি করেন। যিনি তৈরি করেছেন ইঞ্জিনটি কীভাবে পরিচালনা করতে হবে, তিনি সবচেয়ে ভালো জানেন। সৃষ্টিকর্তা মানুষ নামক পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ইঞ্জিন সৃষ্টি করেছেন। তিনিই ভালো জানেন এই মানব-ইঞ্জিন কীভাবে পরিচালনা করলে ভালো থাকবে। এই ইঞ্জিনের সমস্যা সমাধানের পথ সৃষ্টিকর্তা কোরআনে বলে দিয়েছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে, যেকোনো বস্তু, যা মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস করে, তা মাদক হিসেবে বিবেচিত। ইসলাম মাদককে হারাম ঘোষণা করে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইসলাম মানুষকে প্রথমে মাদকের ক্ষতির দিক সম্পর্কে সচেতন করে। আল্লাহতাআলা কুরআনে বলেছেন: ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এতে রয়েছে মহাপাপ, আর মানুষের জন্য উপকারও রয়েছে। তবে এর পাপ উপকারের চেয়েও বড়।’ (সূরা বাকারা: ২১৯)। এই আয়াতটি মানুষকে মাদকের সাময়িক উপকারিতার পাশাপাশি এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির দিকটি উপলব্ধি করাতে সাহায্য করে। মাদক সেবন মানুষের চিন্তাশক্তি এবং ভাষার উপর প্রভাব ফেলে। একবার সাহাবিদের কেউ মদ পান করার পর নামাজে ভুলভাবে কেরাত পাঠ করেন, যা সূরার অর্থ বিকৃত করে। তখন আল্লাহ বলেন: ‘হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছেও যেও না, যতক্ষণ না বুঝতে পারো যা বলছো।’ (সূরা নিসা: ৪৩)। এটি ছিল মাদকের বিরুদ্ধে ইসলামিক বিধানের দ্বিতীয় ধাপ।

শেষ পর্যায়ে ইসলাম মাদককে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করে। কুরআনে বলা হয়েছে: ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্য নির্ধারণের তীর নিক্ষেপÑ এগুলো সব শয়তানের কাজ। কাজেই এগুলো থেকে দূরে থাকো, যাতে তোমরা সফল হও।’ (সূরা মায়েদা: ৯০)। এখানে মাদককে শয়তানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এটি থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মদ পান কোরো না। কেননা তা সকল অকল্যাণের চাবিকাঠি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭১)। বেশির ভাগ আলেমের মতে, মদ অপবিত্র। সুতরাং তা শরীর বা কাপড়ে লাগলে নিয়ম অনুযায়ী পবিত্র করতে হবে; বরং কোনো কোনো আলেম মদ নাপাক বা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ঐকমত্য (ইজমা) দাবি করেছেন। যেমন- আল্লামা ইবনু মুফলিহ (রহ.) বলেছেন, ‘সর্বসম্মতিক্রমে এটা (মদ) হারাম।’ (আল মুবদি : ১/২০৯)। ইমাম নববী (রহ.) মদ নাপাক হওয়ার ব্যাপারে চার ইমামের ঐকমত্য করে বলেছেন, ‘মদ পান করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে রাদগাতুল খাবাল পান করাবেন। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! রাদগাতুল খাবাল কী? তিনি বলেন, জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত পুঁজ ও রক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭৭)।

শরিয়তে মদ পান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং চার খলিফার প্রত্যেকে মদ পানকারীকে শাস্তি দিয়েছেন। এর ভেতর সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বদা মদ পানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩৭৬)। মদ ও মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মানুষ অভিশপ্ত। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) মদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এমন ১০ শ্রেণির লোকের প্রতি অভিশাপ করেছেন : ১. যে লোক মদের নির্যাস বের করে, ২. প্রস্তুতকারক, ৩. মদপানকারী, ৪. যে পান করায়, ৫. মদের আমদানিকারক, ৬. যার জন্য আমদানি করা হয়, ৭. বিক্রেতা, ৮. ক্রেতা, ৯. সরবরাহকারী, ১০. এর লভ্যাংশ ভোগকারী। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ২৭৭)।

মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি, যা ব্যক্তিকে শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে ধ্বংস করে। ইসলাম এই ব্যাধির সমাধান দিয়েছে ধাপে ধাপে নির্দেশনার মাধ্যমে। এটি মানুষকে মাদকের সর্বনাশা ছোবল থেকে রক্ষা করে তাদের একটি সুস্থ এবং সফল জীবনের পথে পরিচালিত করে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য মাদক থেকে দূরে থাকা আমাদের সবার দায়িত্ব। ইসলামের এই বিধান শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি জীবনদায়ী নীতি। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলামের নির্দেশনা সর্বদা প্রাসঙ্গিক এবং মানবতার কল্যাণে এটি একটি চিরন্তন পথপ্রদর্শক।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।

বিভাগ : সম্পাদকীয়

সূত্র, ইনকিলাব