আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের ৬৯টি গুরুত্বপূর্ণ অডিও কলের ক্লিপ জব্দ করা হয়েছে। এসব অডিও বার্তায় গণহত্যাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধের নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। আদালতে উপস্থিত সাক্ষী ও রাজসাক্ষীর জবানিতে সেসব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
দেড় দশকের বেশি সময় ধরে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে শেখ হাসিনা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও তার দলের অনুগত নেতাকর্মীরা গোয়েবলেসীয় কায়দায় তাকে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, ‘মানবতার জননী’ ইত্যাদি মুখরোচক অভিধায় অভিষিক্ত করে ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে দেশের মানুষের কাছে তার আসল চেহারা ধামাচাপা দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল।
বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি থেকে শুরু করে সারাদেশে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা, গণগ্রেফতার, মিথ্যা নাটক সাজিয়ে ক্রস ফায়ার, টার্গেটেড কিলিং এবং পঙ্গু করে দেয়ার পেছনে যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল তা এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান ঠেকাতে শেখ হাসিনা ও ইনুগং পারস্পরিক যোগসাজশে যে সব নাশকতা ও নির্মম পন্থা গ্রহণ করেছিল তা মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা ও বিবেক-বিবেচনাকে হার মানায়।
কোনো সুস্থ চিন্তাধারার মানুষ লাখ লাখ মানুষের উপর এমন ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা ও নির্মম নিপীড়ন চাপিয়ে দিতে পারে, এমন দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। এই দফায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অনেক আগেই তার উদ্ভট-অস্বাভাবিক আচরণের জন্য দেশের উচ্চ আদালত হাসিনাকে ‘রং হেডেড’ আখ্যা দিয়েছিল। এবারের দুঃশাসন ও ধারাবাহিক নিপীড়ন, গণহত্যা ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসছে, কোনো কিছুর সাথেই তার তুলনা হয় না।
চব্বিশের জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থদের উপর গুলি চালিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করা হয়েছে মেট্টোরেল, বিটিভি ভবন ও সেতুভবনে আগুন দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার আগে মেট্টোরেল, সেতু ভবন ও বিটিভি ভবন দেখতে গিয়ে আগুনের ক্ষয়ক্ষতি ও ভাঙচুরের দৃশ্য দেখে কেঁদেকেটে রুমাল ভিজিয়েছেন। এরপর লোক দেখাতে হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছেন বটে, তিনি সেখানে গিয়ে ডাক্তারদের নির্দেশ দিয়েছেন ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবে হাজার হাজার আহত ছাত্র-জনতা মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্বের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি জব্দ হওয়া অডিও ক্লিপ থেকে জানা গেল, শেখ হাসিনা নিজেই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
নিজেই আগুন দেয়ার নির্দেশ দিয়ে তার দায় ছাত্র-জনতার উপর চাপিয়ে স্থাপনার ভাঙ্গা কাঁচ ও দরোজা-জানালা সিলিং দেখে দুঃখে কাতর হয়েছেন। এমন নাটকবাজি বিশ্বে আর কোথাও হয় কিনা আমাদের জানা নেই। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ও ভারতবিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে জঙ্গিবাদ ও একাত্তুরের যুদ্ধাপরাধের পরিকল্পিত অভিযোগ সাজিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ফাঁসি দেয়ার মত আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে চিহ্নিত করে ফাঁসি দেয়ার পরিকল্পনা ছিল হাসিনার। জব্দকৃত অডিও ক্লিপে হাসানুল হক ইনুর সাথে টেলিফোন আলাপচারিতার সে তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে ঢাকাসহ সারাদেশে গণগ্রেফতারের পাশাপাশি ঢাকার প্রধান প্রবেশপথ নারায়ণগঞ্জের হাইওয়ে, শনির আখড়ায় হেলিকপ্টার থেকে বম্বিং করে এবং ছত্রিসেনা নামিয়ে আন্দোলনকারীদের নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশও দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে অনেক মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটলেও সে সময় শেখ হাসিনা তা অস্বীকার করে হেলিকপ্টার থেকে পানি ছিটানোর উদ্ভট তথ্যও হাজির করেছিলেন।
সব বিরোধী শক্তিকে নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করে শেখ হাসিনা তার পিতাকে দেবতার আসনে বসিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার পরিবারকে দেশের একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। নিজের এমন পতন ছিল কল্পনাতীত। পতনের পর সবকিছু রাজনৈতিক ও আইনগতভাবে মোকাবেলা করার সাহস, শক্তি কিংবা সক্ষমতা তার ছিল না, এখনো নেই। এমনকি হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলির কারণে জনমনে সৃষ্ট সংক্ষোভ, ঘৃণার বিপরীতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ও দেশবাসির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তাও তিনি বোধ করছেন না। জুলাই অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করে এখনো বিদেশে বসে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ছত্রছায়ায় দেড় দশক ধরে দেশের মানুষের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে দেশের সব কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা যেভাবে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, ঠিক একই ধারাবাহিকতায় এখন ভারতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যহত করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বিচার এড়িয়ে রাজনৈতিক পুনর্বাসনের স্বপ্ন দেখছেন। পিলখানায় পরিকল্পিত গণহত্যার মধ্যদিয়ে দেশের সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে দেয়া, দেশের কোটি কোটি মানুষের উপর চরম ঘৃণা, নির্মমতা, অসংখ্য গুম-খুন, শাপলা চত্বরে মাস কিলিং ও জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার মতো ঘটনার সাথে ব্যক্তিগতভাবে ও দলীয়ভাবে জড়িত থাকার প্রামাণ্য তথ্য ও দলিল জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ার পরও এক শ্রেণির মানুষ আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের ও নির্বাচনে আনার স্বপ্ন দেখছে। এরাই স্বৈরাচার ও গণহত্যাকারীদের দোসর, এদেরকেও চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। দেড় দশকে দেশে যত বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ও গুম-খুনের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সবগুলোর সাথেই শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে জব্দকৃত অডিও ক্লিপে যে সব তথ্য উঠে এসেছে তাতে হাসিনা ও তার দোসরদের অপরাধের ফিরিস্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি উন্মোচিত হয়েছে। অপরাধী সব সময়ই অপরাধের স্বাক্ষর রেখে যায়। এমন আরো বহু গুম-খুন ও হত্যাকা-ের আলামত শত শত অডিও ক্লিপে ছড়িয়ে আছে। সে সব উদ্ধার করে জনস্মুখে হাজির করতে হবে। এসব আলামত ঘটনার বিবরণ যথাযথভাবে সংরক্ষণসহ দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে। দেশবাসী তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির বাস্তবায়ন দেখতে চায়। ভবিষ্যতে আর কেউ বা কোনো রাজনৈতিক দল যেন এমন ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে, সে দিকে দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ থাকতে হবে।