ফিলিস্তিনের জেরুজালেম মানবসভ্যতা ও আব্রাহামিক রিলিজিয়ন হিসেবে পরিচিত ৩টি প্রধান ধর্মের সূতিকাগার। বিশ্বসভ্যতা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের উপর হাজার বছর ধরে বিশ্বের মনোযোগ ও প্রভাব কাজ করছে। গ্রীক, রোমান, ইহুদি, খৃষ্টান, পারসিয়ান সভ্যতার হাত বদল হয়ে এখানে বিজয়ী শক্তি হিসেবে মুসলমানদের আবির্ভাব অধিকার শান্তি ও স্থিতিশীল সভ্যতার নির্নায়ক হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানরা কোনো জাতির উপর ভয়াবহ যুদ্ধ-সংঘাত চাপিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক বিজয় অর্জনের পন্থা অনুসরণ করেনি। রোমানদের ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার উপর অধ:পতিত ইউরোপীয় রাজশক্তিগুলোর পারস্পরিক বিশৃঙ্খলা, বিচারহীনতা ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার এক জটিল সময়ে স্পেন তথা আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় মুসলমান দিগি¦জয়ীদের আগমনের মধ্য দিয়ে বিশ্বসভ্যতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। খৃষ্ট ধর্মের যাজকতন্ত্রকে আশ্রয় করে অভিজাত শ্রেণীর আধিপত্যের গ্যারাকলে সাধারণ মানুষের নিস্পেষিত হওয়ার বাস্তবতা নতুন ধর্মীয় উন্মাদনার মাধ্যমে ঢেকে দেয়ার প্রয়াস হিসেবেই খৃষ্টীয় দশম শতকে ইউরোপের রাজশক্তিগুলো ধর্মীয় ঐক্য সৃষ্টি করে ক্রুসেডের ডাক দিয়ে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দিতে চেয়েছিল। পরবর্তী দুইশ বছরে অন্তত ৮টি ক্রুসেডে হাজার হাজার ধর্মযোদ্ধার মৃত্যু ঘটলেও মুসলমানদের বিজয় ঠেকাতে পারেনি। হজরত মোহাম্মদ (স.) এর ওফাতের মাত্র তিন বছরের মাথায় ৬৩৬-৩৭ খৃষ্টাব্দে রাশিদুন খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাবের আমলে সেনা কমান্ডার আবু ওবায়দার নেতৃত্বে মেরাজের স্মৃতি বিজড়িত জেরুজালেম অবরোধের সম্মুখীন হয়। সে সময়ে জেরুজালেমে বাইজান্টাইন শাসক ধর্মযাজক সফ্রোনিয়াস খলিফার হাতে জেরুজালেমের চাবি হস্তান্তরে সম্মত হলে খলিফা ওমর জেরুজালেমে এসে জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাসসহ নগরীর দায়িত্ব বুঝে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এর সাড়ে চারশ বছর পর ইউরোপের সামন্ত রাজারা তাদের ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করে ১০৯৫ সালে প্রথম ক্রুসেডের ডাক দিলে ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করলে প্রায় ৯ দশক জেরুজালেম ফরাসী খৃষ্টানদের দখলে থাকে। ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির নেতেৃত্বে হিত্তিনের যুদ্ধে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের পতনের মধ্য দিয়ে জেরুজালেম পুনরায় মুসলমানদের শাসনাধীনে আসে। যা’ প্রথম মহাযুদ্ধে ওসমানীয় খিলাফতের পতনের মধ্য দিয়ে বৃটিশ ম্যান্ডেটে পরিনত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে বৃটিশ বাহিনীর বিপর্যয় ঠেকাতে ইহুদি ধনকুবেরদের সমর্থন নিশ্চিত করতে তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর তার ব্যক্তিগত বন্ধু ইহুদি কমিউনিটি নেতা লর্ড রথশিল্ডের কাছে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন আবাসভ’মির নিশ্চিয়তা দিয়ে ১৯১৭ সালে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠি বালফোর ডিক্লারেশন নামে পরিচিত। তবে ফিলিস্তিনে মুসলমানদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যে খুব গৌণ সংখ্যক ইহুদি জনগোষ্ঠিকে নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ছিল অবাস্তব। এ জন্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানি ও ইউরোপে নাৎসিদের ইহুদি বিরোধী তৎপরতা ও কথিত হলোকস্টের ঘটনাকে পুঁজি করে ইহুদিদের জন্য বালফোর প্রস্তাবিত জেরুজালেমে স্বাধীন আবাসভ’মি গড়ে তোলার এক সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনার আওতায় তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে আরবদের ভূমি ইহুদিদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করেও যখন রাষ্ট্র গঠনের মত জনসংখ্যা ও ভূমির সংস্থান করা যায়নি, তখন হাজার হাজার ইহুদি যুবককে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র হাঘানান বাহিনী গঠন করে অস্ত্রশস্ত্রসহ জাহাজ বোঝাই করে ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে হাঘানা মিলিশিয়ারা আকষ্মিক নিরস্ত্র আরব ফিলিস্তিনিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা সন্ত্রাস ও ম্যাসাকারের মুখে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এ জন্য তারা সদ্য গঠিত জাতিসংঘে একটি একতরফা প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিয়েছিল। যদিও ইসরাইলিরা সে প্রস্তাবের শর্তগুলোও পালন করেনি। জেরুজালেম ও আল আকসার স্বাধীনতার প্রশ্নে বিপ্লবোত্তর ইরানের শাসকরাই সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। ইরানের সাথে সউদি, আমিরাত, মিশর, তুরষ্ক, জর্ডান ও সিরিয়ার মত দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে রিজিম চেঞ্জ ও গাজায় গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের মত ঘটনা ঘটানোর সাহস ইসরাইল কখনো পেত নো।

ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে গায়ের জোরে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন মহাযুদ্ধোত্তর বিংশ শতকের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। উসমানীয় খেলাফত ভেঙ্গে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইঙ্গ-মার্কিন বশংবদ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার তেল, স্বর্ণসহ প্রাকৃতিক সম্পদ ও রাজনীতির উপর চিরস্থায়ী নিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্ত কায়েম করা হয়। মূলত: ক্ষমতালোভী আরবদের বিদ্রোহী করে তোলার মধ্য দিয়েই প্রথম মহাযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের পতন নিশ্চিত করা হয়। একশ বছর পেরিয়ে এসেও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত ঘিরে ইউরোপের শক্তিগুলোর মধ্যে প্রথম বোঝাপড়া ও সমঝোতা হয়েছিল ১৯১৬ সালে সাইক্স-পিকো চুক্তির মধ্য দিয়ে। বৃটিশ, ফরাসি ও ইতালির মধ্যে এই সমঝোতার আওতায় পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মধ্যপ্রাচ্যের উপর এসব দেশের নিয়ন্ত্রণ অটুট রয়েছে। সিরিয়া, আলজেরিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর উপর ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণ, ফিলিস্তিন, জর্ডান, সউদি আরব, মিশর ও আরব আমিরাতসহ ভারতীয় উপমহাদেশের উপর বৃটিশদের নিয়ন্ত্রণ এবং লিবিয়া, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, আলবেনিয়ায় ইতালির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব দেশের বিষয়-আশয় নিয়ে শত বছর আগে তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা নিরবে রক্ষিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠলেও দেশগুলোর উপর কলোনিয়াল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পুরনো বন্দোবস্তকে মার্কিনীরাও সমীহ করে থাকে। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্পদের অধিকার ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে জ্বালানি ও শিল্পের কাঁচামাল লুটে নেয়ার পুঁজিবাদী বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমাদের মধ্যে বন্ধন অটুট রাখতে নানাবিধ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। পঞ্চশক্তির মধ্যকার ভারসাম্যহীনতার কারণে এক সময় জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একাধিপত্য ধরে রাখতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডাব্লিউটিও, ইউএনডিপি, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদি সংস্থা ও জোটগুলো মূলত বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্পদের উপর একচ্ছত্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে। এ সপ্তাহে কানাডায় অনুষ্ঠেয় জিÑসেভেন সামিটে চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। বিশ্বব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে রাশিয়া এবং চীনের মত পরাশক্তিকেও সামিটের বাইরে রাখা হচ্ছে। আরব-ইসরাইল সংকট, ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলী আগ্রাসন, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধসহ প্রায় প্রতিটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংকটে জি-সেভেনভুক্ত পুঁজিাবাদী রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগতভাবে প্রায় অভিন্ন অবস্থান দেখা যায়। ফিলিস্তিনিরা কখনোই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিত্যাগ করেনি। পঁচাত্তর বছরের বেশি সময় ধরে অন্যায়ভাবে বাস্তুহীন, রাষ্ট্রহীন করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে জায়নবাদি ইসরাইল। ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট এবং এশিয়া আফ্রিকায় তাদের বশংবদ শাসকরা নীরব দর্শক তথা নিরব সমর্থকের ভূমিকা পালন করছে। শুরুর দিকে আরব ইসরাইল যুদ্ধে জনগণের চাপে এক ধরনের আরব ঐক্য দেখা গেলেও প্রথম মহাযুদ্ধে আরব রিভল্টের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজপরিবার ও মিশর-জর্ডানের মত দেশগুলোকে বশ মানাতে গত ৬ দশকে ইঙ্গ-মার্কিনীদের যত রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেছে, আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিরসনে তার একভাগও দেখা যায়নি। বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ, বাণিজ্য ও প্রযুক্তির উপর পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ ইউরোপ-আমেরিকার হাতে অটুট রাখতে ইসরাইলকে একটি অজেয় দানবীয় শক্তি রূপে টিকিয়ে রাখাকে তারা অপরিহার্য মনে করছে। মধ্যপ্রাচ্যের ৫০ কোটি মানুষের জীবন, ভাগ্য ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নস্যাতের বিনিময়ে তারা ইসরাইলের তথাকথিত নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলে আসছে।

অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল পশ্চিমাদের গোপন সমর্থন ও সহযোগিতায় পারমানবিক অস্ত্র ভান্ডার গড়ে তুলেছে। ইসরাইলের পারমানবিক প্রকল্প আন্তর্জাতিক নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ বা প্রটোকলের বাইরে। ইরান, পাকিস্তানের মত দেশ এনপিটিতে স্বাক্ষর করলেও ইসরাইল এখনো করেনি। বিশ্ব মোড়লদের কেউ তাকে সেটা করতে বলছে না। দিমোনা পরমানু কেন্দ্রের একজন টেকনিশিয়ান ভানুনু মোরদেচাই ১৯৮৬ সালে প্রথম বিবেকের তাড়নায় ইসরাইলের পারমানবিক সমরাস্ত্রের তথ্য বিশ্বের সামনে ফাঁস করে দেন তিনি। তার দেয়া দিমোনা পরমানু কেন্দ্রের গোপণ ছবিসহ তথ্য লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ অপরাধে লন্ডনে অবস্থানরত মোরদেচাইকে ইসরাইলে ধরে আনে মোসাদ। এরপর তাকে ১৮ বছরের কারাদন্ড দেয় ইসরাইল সরকার। সাজাশেষে ২০০৪ সালে জেল থেকে বের হলেও মোসাদের নজরদারি ও বিধি নিষেধের কারণে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেনি মোরদেচাই। এমন একটি তথ্য বেরিয়ে আসার পরও জায়নবাদী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের পারমানবিক সমরাস্ত্রের বিষয়ে আরবদের উদ্বেগ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে সঠিক তথ্য, জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করতে পারেনি বিশ্ব সম্প্রদায়। অন্যদিকে ইরানের এনপিটিতে স্বাক্ষর, আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থার নিয়মিত নজরদারি এবং শান্তিপূর্ণ কাজে পারামানবিক শক্তি ব্যবহারের ইরানের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ইরানের কথিত পরমাণু বোমার ধুয়া তুলে দশকের পর দশক ধরে ইরানের উপর বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ইঙ্গ-মার্কিন অক্ষ। বিশ্বব্যবস্থার উপর তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টার্গেট দেশের উপর প্রথমে অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দুর্বল করা অত:পর সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে শেষ করে দেয়ার কারসাজি পশ্চিমাদের পুরনো পন্থা। প্রথম গাল্ফ ওয়ারের আগে ইরাককে কুয়েত দখলে পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করার পর ইরাকের কুয়েত দখলের কয়েক ঘন্টার মধ্যে কোনো রকম কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ১৯৯১ সালে ইরাকের উপর ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসন চালায়। এরপর একযুগ ধরে ইরাকের উপর অবরোধে দেশটি যখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নাইন-ইলেভেনের পর গণবিদ্ধংসী অস্ত্রের মুজদ থাকার অভিযোগ তুলে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশটি দখল করে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেনকে উস্কে দিয়ে আশির দশকের শুরুতে ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানের উপর ৮ বছরের যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে পশ্চিমারা। ইরানের আঞ্চলিক অখন্ডতা বিনষ্ট করা এবং ইরাকের উপর যুদ্ধের বিশাল অর্থনৈতিক দায় চাপিয়ে দেউলিয়া করে দেয়ার মাধ্যমে দায় মেটাতে ইরাককে কুয়েত দখলে প্ররোচিত করে আগ্রাসন চালিয়ে ইরাক দখলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল পশ্চিমারা। অত:পর সাদ্দাম হোসেনকে গোপন আস্তানা থেকে ধরে এনে মতৃ্যুদন্ড দেয় মার্কিন বাহিনী। পশ্চিমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পারমানবিক প্রকল্প পরিত্যাগ করে লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল কর্ণেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তার ফলফল হল, প্রক্সি বিদ্রোহের নাটক সাজিয়ে লিবিয়াকে তছনছ করে গাদ্দাফিকে প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যার শিকার হতে হয়। গাদ্দাফি লিবিয়া এবং আফ্রিকায় পশ্চিমা কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর জনগণের প্রাপ্য অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি আফ্রিকায় একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এসব প্রচেষ্টা পশ্চিমা সামরাজ্যবাদী স্বার্থের পরিপন্থি।

গত বছর ১৬ জুন আইসিএইচ ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘সিরিয়াল ক্রিমিনালস রুল ইসরায়েল, দ্যাটস হয়ার দ্য কলাপ্স বিগিনস’ জাত ক্রিমিনালরা ইসরাইল শাসন করছে, এ কারণেই এর পতন শুরু হয়েছে। লেখকের নাম মরদেচাই গিলাত। তিনি একজন ইসরাইলী অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তার বক্তব্যের সারবস্তু হচ্ছে, ইসরাইলী জাতিয়তাবাদী রাজনীতির প্রত্যাশার নিরীখে নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রীদের দুর্নীতি, অপকর্ম, আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারিতা, বিচারহীনতা এবং নাগরিকদের অধিকার হরণের কারসাজি করে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র টিকতে পারেনা। নিজ দেশের সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরে তিনি সাংবাদিক হিসেবে নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। যে রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে, অবৈধভাবে গায়ের জোরে অন্যের জমি দখল করে, যে রাষ্ট্র সাড়ে ৭ দশক ধরে টিকে আছে ভূমিপুত্রদের রক্ত ঝরিয়ে এবং প্রতিবেশিদের উপর জুলুম আগ্রাসন ও গণহত্যা চালিয়ে, তার ধ্বংস অনিবার্য। প্রকৃতি তার আপন নিয়মে প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। কোনো উস্কানি বা বাহ্যিক কোনো কার্যকারণ ছাড়াই গত ১৩ জুন রাতের অন্ধকারে ইরানে বিমান হামলা ও গুপ্তহত্যা চালিয়ে সে দেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা, পরমানু বিজ্ঞানী ও বেসামরিক নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। এতেই তারা থেমে যায়নি, ইরানের কথিত পরমানু প্রকল্পের সম্পুর্ণ ধ্বংস এবং খামেনির শাসনের বিলুপ্তি না হওয়া পর্যন্ত ওরা থামবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। ইসরাইলে হামাসের অভিযানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্য হিসেবে হামাসের হাতে আটক ইজরাইলী বন্দিদের মুক্ত করে আনার কথা বললেও তাদের মূল এজেন্ডা ছিল গাজার ২৫ লাখ অধিবাসিকে বাস্তুচ্যুত করে গাজা দখল করা। পুরো গাজার ধ্বংস করে, ৬০ হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করে, প্রায় দেড়লাখ আহত এবং ২০ লক্ষাধিক মানুষকে বাস্তুহীন করেও তারা বন্দিদের মুক্ত করতে পারেনি। হামাসকেও নির্মূল করতে পারেনি। ইরাকে বিমান হামলা চালিয়ে ওসিরাক পরমানু রি-অ্যাক্টর ধ্বংস করার ২০ বছর পর সাদ্দাম হোসেনের গণবিদ্ধংসী অস্ত্রের মিথ্যা বয়ান প্রচার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন ও দখল করার নেপথ্য কারিগর ছিল ইসরাইলের সন্ত্রাসী শাসকরা। প্রক্সি বিদ্রোহীদের দিয়ে লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ করার পর দেশগুলো আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পশ্চিমাদের এজেন্ডা অনুসারে ইসরাইল টিকে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সবাইকে ইসরাইলের আজ্ঞাবহ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের বশংবদ হয়ে টিকে থাকতে হবে। ইতিপূর্বে যে সব দেশে সামরিক আগ্রাসন ও রিজিম চেঞ্জ করা হয়েছে তারা মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নে আপসহীন ছিল। এ ধরণে শক্তিগুলো নিজেদের সম্পদ, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে যেকোনো সময় আঞ্চলিক ঐক্যের ডাক দিতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে সউদি শাসকদের সাথে ইরানের দূরত্ব কমিয়ে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সূচনা হতে চলেছিল। সে ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়ার মত পরাশক্তির অনুঘটকের ভ’মিকা ইসরাইল ও পশ্চিমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে রিজিম চেঞ্জের চুড়ান্ত টার্গেট যে ইরান তা সবাই জানে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি, সেনাঘাঁটি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সরাসরি আঘাতের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প মতিভ্রষ্ট নেতানিয়াহুকে দিয়ে ইরানে হামলা চালিয়ে চুড়ান্ত যুদ্ধের সূচনা করেছে। ইরানের আভ্যন্তরীন বিশ্বাসঘাতক মোসাদ এজেন্টদের কারণে প্রথম ধাক্কায় ইরান সামরিক নেতা ও বিজ্ঞানীদের হারিয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হলেও ইসরাইলের সব অহঙ্কার গুড়িয়ে দিয়ে মোক্ষম প্রত্যাঘাত করতে একদিনও সময় নেয়নি ইরানের বিপ্লবী বাহিনী। রাজধানী তেল আবিব, বন্দর নগরী হাইফাসহ বেশ কয়েকটি শহর এবং সামরিক সদরদপ্তর ধ্বংস করে মাত্র ৩ দিনেই ইসরাইলকে যুদ্ধের স্বাদ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে চুড়ান্ত ধ্বংসের আগে নেতানিয়াহু থামবে না। একটি পারমানবিক যুদ্ধে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁকি নিতে না চাইলে পশ্চিমারা ইসরাইলকে থামিয়ে দিতে পারে। অন্যথায় ইরান এবং তার মিত্ররা ইসরাইলের পতন ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে এক নতুন ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করবে।

সূত্র, ইনকিলাব