বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ) যানবাহন নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের সময় প্রতি বছর অগ্রিম কর পরিশোধ করতে হয়।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ) যানবাহন নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের সময় প্রতি বছর অগ্রিম কর পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে ১৩ ধরনের বাণিজ্যিক মোটরযানের জন্য নিবন্ধনের সময় ৪ হাজার থেকে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা অগ্রিম কর আদায় করা হয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ কর ৭ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বাস, ট্রাকসহ বাণিজ্যিক যানবাহন ব্যবস্থাপনা খরচ বাড়ছে। গাড়িভেদে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে অগ্রিম কর (অ্যাডভান্স ট্যাক্স)। এ অগ্রিম কর বাড়ায় যাত্রীদের ওপর চাপ পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নামে আয়কর হলেও আদায় পদ্ধতি পরোক্ষ কর প্রকৃতির। মূলত বাস মালিকরা এটি যাত্রীদের থেকেই আদায় করবেন। কাজেই এতে অবশ্যই যাত্রীদের ব্যয় বাড়বে, যা ভোক্তা ব্যয় বাড়িয়ে দেশে বিদ্যমান উচ্চমূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে।

পরিবহন ব্যয় ব্যক্তির মোট আয়ের ১০ শতাংশের মধ্যে থাকলে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে সেটিকে সহনীয় ধরা হয়। এখন এ ব্যয় ১০ শতাংশের অনেক বেশি। এ অস্বাভাবিক পরিবহন ব্যয় বাড়ার পেছনে বেশকিছু কারণ দায়ী। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় গত দুই দশকে দেশের সড়ক অবকাঠামোয় বড় পরিবর্তন এসেছে। নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে বিদ্যমান সড়ক-মহাসড়ক। কিন্তু বিপুল বিনিয়োগেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল। কমছে না যানজট। যানজটের কারণে বাস-ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরিসহ সব যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কে। পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিতে এর একটা ভূমিকা রয়েছে। আছে পরিবহন খাতের অনিয়মের প্রভাবও। সময়ান্তরে খাতটি আরো সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী হয়েছে। অথচ এ খাতে অবসান হয়নি বিশৃঙ্খলা ও চাঁদাবাজি। পথে পথে, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য। প্রতিটি যানবাহনকে বিভিন্ন জায়গায় গুনতে হচ্ছে অন্যায্য মাশুল, যার চূড়ান্ত চাপ গিয়ে পড়ছে ভোক্তার ওপর। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে মিল রেখে পণ্যবাহীসহ সব ধরনের স্থল পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। নৌপথেও নেয়া হয় একই ধরনের উদ্যোগ। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম হ্রাসের সঙ্গে মিল রেখে পণ্যবাহীসহ সব ধরনের স্থল পরিবহনের ভাড়া কমানো হয় না। অর্থাৎ একবার ভাড়া বাড়লে সেই ভাড়া আর কমানো হয় না। চলতি বছরের মে মাসে জ্বালানি তেলের দাম দুই দফা কমানো হলেও পরিবহনের ভাড়া অপরিবর্তিতই থাকে। সব মিলিয়ে পরিবহনের ভাড়া বাড়লে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যয়।

শুধু জনজীবন নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেও এর প্রভাব বিদ্যমান। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি আমদানি-রফতানি। পরিবহন ব্যয় বেশি হলে তার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ে আমদানি-রফতানিতে। একইভাবে কৃষিসহ স্থানীয় বাণিজ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলে, যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়ে। বিশ্বব্যাংক বলছে, পরিবহন ব্যয় কমানো গেলে দেশের রফতানি ২০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। সুতরাং বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় পরিবহন ব্যয়ের লাগাম টানা প্রয়োজন।

এছাড়া পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, যা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে পণ্যের দামের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যায়। সামগ্রিকভাবে তা উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ প্রধান একটি উদ্বেগের জায়গা। পরিবহন ব্যয় বাড়লে ব্যবসার লাভ কমে যায় এবং নতুন ব্যবসা শুরু করতেও অসুবিধা হয়। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ব্যবসার উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। পরিবহন ব্যয় বাড়লে ব্যবসার লাভ কমে, অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এতে কর্মসংস্থানে ভাটা পড়ে এবং বেকারত্ব বেড়ে যায়।

সিঙ্গাপুরে পরিবহন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি গঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। এক দশকের ব্যবধানে সংস্থাটি দেশটির পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। গ্রাহক সন্তুষ্টির দিক থেকে সিঙ্গাপুরের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে এক নম্বর। বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে সিঙ্গাপুরের নামটি সামনে চলে আসে। চীন, জাপান, দুবাই, সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশের পরিবহন ব্যবস্থা বিশ্বে আদর্শ। প্রতিটি দেশই সড়ক, নৌ, রেল ও আকাশপথের সমন্বয়ে একটি পরিপূর্ণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি নির্দেশকও বটে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা এখনো যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেছে। মানসম্পন্ন যোগাযোগ ও পরিবহন কোনো ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি দেশে। বাংলাদেশের উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা বলতে শুধু অবকাঠামো নির্মাণকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। একথা সত্য, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার জন্য উন্নত ও মানসম্পন্ন অবকাঠামো প্রয়োজন, তবে একমাত্র মানদণ্ড নয়। অন্যান্য মানদণ্ডে উন্নতি ব্যতিরেকে মানসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মানদণ্ডের মধ্যে ভ্রমণ বা পণ্য পরিবহনের সময় ও ব্যয়, নিরাপদ ও আরামদায়ক যাত্রা, সড়কের মান, যানজট, চালকের দক্ষতা, দুর্ঘটনার হার, ভাড়া নির্ধারণের সমতা, উৎপাদনশীলতা, পরিবহনের গতি, মূলধন ও পরিচালন ব্যয় পরিবেশ দূষণ, জ্বালানি খরচ, বাস্তুচ্যুতি, আর্থ-সামাজিক প্রভাব, সেবার মান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর কোনো মানদণ্ডেই বাংলাদেশ উন্নীত হতে পারছে না। কিলোমিটার প্রতি ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহন ব্যয় এখানে অনেক বেশি। পরিবহন ব্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন দেশের উদ্যোক্তারা, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের বড় বাধাও এটি। যানজটের কারণে সেবাগ্রহীতার সময় ও ব্যয় বাড়ছে। দুর্বল পবিরহন ব্যবস্থার সুযোগে ব্যয় বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত বেশি। আয়কর কিংবা জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য চলে। বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হলে একে নিরাপদ, জনগণের সামর্থ্যের মধ্যে ভাড়া নির্ধারণ, শূন্য দুর্ঘটনা, ফুটপাত উন্নত করা, পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন পরিবহন সেবা, টেকসই, আরামদায়ক, সবার জন্য সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরেই দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতি বিরাজমান। এতে জীবনযাত্রা ব্যয়ে এমনিতেই বিপর্যস্ত মানুষ। তার মধ্যে যেভাবে অগ্রিম আয়কর বাড়ানো হয়েছে তার প্রভাবে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যয় বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে মানুষের জীবন ব্যয় আরো বাড়িয়ে দেবে। এমন হলে মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন আরো ব্যয়বহুল ও দুরূহ হয়ে উঠবে। সুতরাং পরিবহন ব্যয় যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে সেজন্য পরিবহন খাতে অগ্রিম আয়কর সহনীয় রাখতে হবে। এছাড়া পরিবহন খাতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সুশৃঙ্খলা। পরিবহন মালিকদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। সর্বোপরি বাড়াতে হবে রাষ্ট্রীয় নজরদারি।

সূত্র, বণিক বার্তা