বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের বাজার ও সরবরাহে অস্থির অবস্থা প্রায়ই দৃশ্যমান। সৃষ্টি হয় জনরোষ, মেহনতি মানুষ পড়ে দুর্ভোগে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের বাজার ও সরবরাহে অস্থির অবস্থা প্রায়ই দৃশ্যমান। সৃষ্টি হয় জনরোষ, মেহনতি মানুষ পড়ে দুর্ভোগে। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় কৃষিপণ্য আমদানিতে, যা আদৌ আমাদের কাম্য নয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা যায়, ২০২১-২২ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য আমদানি ব্যয় যথাক্রমে ৫ দশমিক ৩ ও ৪ বিলিয়ন ডলার, যা ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্য মিলিয়ে ৬ বিলিয়ন ডলার প্রায়। দেশীয় চাহিদার ৮৫ শতাংশ গম ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছে; ৬৬ লাখ ৬২ হাজার টন গম আমদানি করতে ব্যয় হয়েছে ৫৪ দশমিক ১৭ কোটি ডলার।

একই অর্থবছরে দেশীয় চাহিদার ৭০ শতাংশ, মসুর ডাল (৫৯ লাখ ২৯ হাজার টন), আলু আমদানি করা হয়েছে ৯৭ হাজার ২১৯ টন, মুগ ডাল ৬ হাজার ৮৯৫ টন, ছোলা ১ লাখ ৮০ হাজার টন। ভোজ্যতেল দেশীয় চাহিদার ৯৭ শতাংশ করতে হয় আমদানি।

একই অর্থবছরে রাফ ও রিফাইন্ড চিনি আমদানি করা হয়েছে মোট ১৩ দশমিক ৮৬ লাখ টন, যার বাজার মূল্য ছিল ১ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। ফ্রিজিং মাছ ১ দশমিক ১০ হাজার টন আমদানি করতে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। আমরা ভারত, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়া থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফ্রিজিং মাংস আমদানি করি।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার টন শিশুখাদ্য আমদানি করা হয়েছে, যার মূল্য ছিল প্রায় ২২৩ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশে শিশুখাদ্যের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১০-১২ হাজার টন। এ চাহিদা সম্পূর্ণভাবে আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮৯৪ টন তাজা ফল আমদানি করা হয়েছে। ২০২২ সালে পেয়ারা (এইচএস কোড ০৮৪৫০) আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ২৫ হাজার ৭৪০ কেজি, যার মোট মূল্য ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৭২০ ইউএস ডলার।

২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ হাজার ৬০২টি পেঁপে আমদানি শিপমেন্ট হয়েছে। প্রতিটি শিপমেন্টের গড় মূল্য কয়েক হাজার মার্কিন ডলার হতে পারে।

সর্বাঙ্গে প্রয়োজন ‘জাতীয় আমদানি বিকল্প কৃষিনীতি’ প্রণয়ন। এক্ষেত্রে আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, আমরা কৃষিপণ্য (যে পণ্য কম ব্যয়ে যে এলাকায় অধিক পরিমাণে উৎপাদন করতে পারি) সুনির্দিষ্টভাবে উৎপাদন এলাকা ভাগ করে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণসহ উৎপাদন নির্দেশনা প্রদান করতে পারি, তাহলে আমরা দেশজ চাহিদা পূরণ করতে পারি।

আমি যদি ধরে ধরে বলি, শিশুখাদ্য যেমন দুগ্ধজাতীয় খাদ্য: বাংলাদেশের বিশাল চর এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ঘাস দিয়েই আমরা গরু, মহিষ ও ছাগল চাষ করে দুগ্ধজাতীয় খাদ্যসহ মাংসের চাহিদা মেটাতে পারি। পেয়ারা দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমিতে (পাহাড়ি এলাকাসহ) উৎপাদন করতে পারি। একইভাবে সম্ভব পেঁপে চাষও। আগেকার সময়ের চেয়ে মাছ চাষ বেড়েছে, এখন শুধু প্রয়োজন মাছের উন্নতমানের পোনা সরবরাহের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান।

মনে করা যাক, ২০২৩ সালে আমরা মোট ৬৭ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ কেজি আদা ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে ৪৫ দশমিক ৫৬ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে আমদানি করেছি। একই সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছি ৮৮ কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার কেজি, যার মোট মূল্য প্রায় ২১০ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ডলার। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই বলব যে আদা এমনি একটি পণ্য, যা গ্রামগঞ্জে, বনজঙ্গলে যেকোনো ছায়া জায়গায় উৎপাদন করা যেতে পারে। এজন্য খুব বেশি কষ্টের প্রয়োজন হয় না। পেঁয়াজের চাহিদা পূরণে প্রয়োজন উন্নত বীজ সরবরাহ ও এলাকাভিত্তিক উপযুক্ত জমি ঠিক করে দেয়া।

ধরুন, এবার আলুর উৎপাদন ভালো। কিন্তু আলু সংরক্ষণবিষয়ক জটিলতায় এবারে সংশ্লিষ্ট চাষীর মাথায় হাত! অর্থনীতিবিদ কব-ডগলাসের তত্ত্বমতে, চলতি বছরে কৃষক যেহেতু আলু উৎপাদন করে লোকসানসহ সংরক্ষণের সংকটে পড়েছে, সেহেতু আগামী বছর সংশ্লিষ্ট চাষী আলু উৎপাদনে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ হারাবেন।

বাংলাদেশে টমেটোর চাহিদা প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের টমেটো আমদানি করেছি।

এ প্রবন্ধে ‘আমদানি বিকল্প কৃষিনীতি’—ধারণাটি উপস্থাপন করলাম। শেষ করব এ বলে—আমরা কি কৃষিপণ্য (শস্য, মৎস্য, গবাদি পশু ও বনায়ন) উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই? না, পরনির্ভরশীল থাকতে চাই? প্রশ্নটির ফয়সালা হওয়া প্রয়োজন প্রথমেই। অত্যন্ত দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বলব, যেসব উন্নত দেশ যেমন শিল্প বিপ্লবের আগে কৃষি বিপ্লব সম্পন্ন করেছে আমাদের তেমন পথেই চলা উচিত। না হয় এ কথাই ভবিষ্যতে মনে পড়বে—‘‌ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’।

ড. আবদুর রহমান: অধ্যাপক ও উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) ও কোষাধ্যক্ষ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি

সূত্র, বণিক বার্তা