বিখ্যাত ইংরেজ লেখক উইলফ্রেড ওয়েনের একটি অসাধারণ যুদ্ধবিরোধী কবিতা রহিয়াছে। সেইখানে তিনি বলিয়াছেন- 'যদি তুমি দেখিতে পারিতে/ কেমন করিয়া রক্তে ভাসিয়া যায় তাহার ফুসফুস,/ কেমন করিয়া সে হেঁচকি তোলে,/ মৃত্যু ঠেকাইতে ব্যর্থ এক জীবন্ত দগ্ধ শরীর তাহার/তবে তুমি বলিতে না-যুদ্ধের জন্য জীবন দেওয়াটাই মহৎ কাজ!' প্রকৃত অর্থে, পৃথিবীর ইতিহাস যুদ্ধের রক্তরঞ্জিত পৃষ্ঠায় রচিত। সভ্যতার উষালগ্ন হইতে মানবজাতি যুদ্ধকে সঙ্গী করিয়াই তাহার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখিয়াছে। কখনো যুদ্ধ ছিল স্বজাতির টিকিয়া থাকার প্রয়াস, কখনো অপরের ভূমি, সম্পদ কিংবা ক্ষমতা দখলের হিংস্র প্রয়াস।

gnewsদৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

আবার কখনো-বা যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষার একমাত্র পথ। মানবসমাজের বিবর্তনের ইতিহাস পাঠ করিলে প্রতীয়মান হয়-যুদ্ধ যেন আমাদের সভ্যতারই এক বিপরীতধর্মী ছায়াপথ, যাহার অস্তিত্ব রহিয়াছে অন্ধকারের গর্ভে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া যায়, আনুমানিক ১০ সহস্র বৎসর পূর্বেই আফ্রিকার নটারুক নামক স্থানে সংঘটিত হইয়াছিল এক সংঘবদ্ধ সহিংসতা-যেইখানে নারকীয়ভাবে হতাহত হয় অনেক মানুষ। ইহা মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম 'যুদ্ধ'-এর নিদর্শন বলিয়া মনে করা হয়। এই তথ্যই প্রমাণ করে, যুদ্ধ মানবজাতির আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টির ফল নহে, বরং তাহা সম্ভবত আদিম প্রবৃত্তির এক উগ্র বহিঃপ্রকাশ। সভ্যতা যতই অগ্রসর হইয়াছে, যুদ্ধের পদ্ধতি ও কলাকৌশল ততই জটিল হইয়াছে, তাহার পরিণামও ততই ভয়াবহ হইয়াছে।

লিখিত ইতিহাসে অন্তত ১৫ হাজার যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া ইতিহাসবিদেরা অনুমান করেন। সেই সকল যুদ্ধের রক্তধারা প্রবাহিত হইয়া আজও বহন করিতেছে মানবসমাজের চেতনায় এক অন্তঃস্থ বেদনা। শুধু বিংশ শতকেই দুইটি বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারায় প্রায় ১০ কোটি মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যাহা মানবজাতির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সংঘাত, তাহা মানবতা, নৈতিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তির উপর এক ভয়াবহ আঘাত। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ যেন যুদ্ধে মানবতা কতখানি নিঃশেষ হইতে পারে, তাহার নির্মম দৃষ্টান্ত।

তবে প্রশ্ন উঠে-এই সমস্ত যুদ্ধ কি অনিবার্য ছিল? সকল যুদ্ধ কি আত্মরক্ষার জন্য? নাকি বহু যুদ্ধই সংঘটিত হইয়াছে নেতৃবৃন্দের অহংবোধ, লোভ কিংবা ভ্রান্ত নীতির কারণে? ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধ বিশ্লেষণ বলিয়া দেয়, বহু যুদ্ধই এড়ানো যাইত। প্রশ্ন হইলে, যুদ্ধ কি সর্বদাই নিন্দনীয়? না, ইতিহাসে এমন যুদ্ধও ঘটিয়াছে, যাহা ছিল ন্যায়ের পক্ষে, নিপীড়িতের মুক্তির নিমিত্তে। আমাদেরই মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক মহাজাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, যেইখানে যুদ্ধ ছিল অনিবার্য, কারণ শান্তির সকল পথ রুদ্ধ হইয়াছিল। অতএব, যুদ্ধকে এক কথায় নিন্দা করা যেমন ভুল, তেমনি তাহার মহিমা গাওয়া আরো ভয়ানক। এইখানেই আসে যুদ্ধের দার্শনিক প্রশ্ন। যুদ্ধ কি কেবল বাহ্যিক সংঘর্ষ, নাকি মানবচেতনায় নিহিত এক অন্তর্দ্বন্দ্ব? দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন কিংবা অ্যাকুইনাস যুদ্ধকে ন্যায়বোধের সীমারেখায় বন্দি করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। তাহাদের মতে, 'যুদ্ধ শুধু তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তাহা আত্মরক্ষা কিংবা বৃহত্তর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে হয় এবং নিরীহকে রক্ষা করিয়া চলে।' অপরদিকে, হোবস বা ম্যাকিয়াভেলি বলিয়া গিয়াছেন-'শক্তিই চূড়ান্ত এবং যুদ্ধ রাজনীতিরই এক প্রাকৃতিক সম্প্রসারণ।'

মানবসমাজ মূলত সংঘাতপ্রবণ এবং রাষ্ট্র নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করিতে গিয়াই যুদ্ধকে আশ্রয় লইয়া থাকে। তবে এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে দাঁড়াইয়াছেন গান্ধী, তলস্তয় কিংবা মার্টিন লুথার কিং, যাহারা ঘোষণা করিয়াছেন- 'অহিংসাই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি।' তাহারা দেখাইয়াছেন, সহিংসতা নয় বরং অনমনীয় নৈতিক দৃঢ়তা এবং অহিংস সংগ্রামই সমাজের টিকসই পরিবর্তন আনিতে সক্ষম। অতএব, যুদ্ধকে কখনই অন্ধভাবে গৌরবের প্রতীক বানানো উচিত নহে। যদিও তাহাকে সর্বদাই নিন্দনীয় বলিয়া উড়াইয়াও দেওয়া যায় না। যুদ্ধকে বুঝিতে হইবে তাহার প্রেক্ষিত, কারণ ও উদ্দেশ্যের নিরিখে। সবচাইতে বড় কথা, যে কোনো যুদ্ধ মানবজীবনের পরিপন্থি। যেখানে সংলাপ, সহানুভূতি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সমাধান সম্ভব, সেখানে যুদ্ধ নিছক এক ব্যর্থতা।

সূত্র, ইত্তেফাক