উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় পাশের হার গত বছরের তুলনায় (৭৭.৭৮ শতাংশ) উল্লেখযোগ্যভাবে কমে ৫৮.৮৩ শতাংশে নেমে এসেছে এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও কমেছে ব্যাপকভাবে। গতবারের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ পরীক্ষার্থী কম পাশ করেছে এবার। সব মিলিয়ে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাশের হারে ধস নেমেছে বলা যায়।
এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে নয়, বরং জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। পাশের হার কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে বোর্ডগুলো হয়তো পরীক্ষার কড়াকড়ি, কঠিন প্রশ্নপত্র বা পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমকে দায়ী করবে। তবে প্রকৃত কারণ সম্ভবত আরও গভীরে নিহিত। শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার যেমনটা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে শেখার সংকট শুরু হয় খুব শুরুর দিকেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শেখার ঘাটতি তৈরি হয় এবং সেই ঘাটতি বছরের পর বছর সঞ্চিত হয়। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চাইনি। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছিল, পাশের হারই ছিল সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদণ্ড। ফল ভালো দেখাতে গিয়ে আমরা অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি। আজ আমি সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই।’ বস্তুত ফলাফলের এই বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত পাঠদান, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য শিক্ষক, বিশেষত গ্রামীণ ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এবং শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি-এ সবকিছুই বিবেচনার দাবি রাখে। ফলাফলের এই চিত্র একইসঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজমান বৈষম্যেরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। শহর ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য এখনো ব্যাপক।
কাজেই শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের উচিত এই ফলকে একটি সতর্কতা হিসাবে নেওয়া। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, পরীক্ষার পদ্ধতির যথার্থতা যাচাই এবং বৈষম্য দূরীকরণে সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তির ক্ষেত্রেও শুধু জিপিএ-৫-এর ওপর নির্ভর না করে সার্বিক মেধা ও দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নয়তো এই ফল শুধু একটি পরিসংখ্যান হয়েই থাকবে, যার গভীর প্রভাব সমাজ ও জাতিকে বহন করতে হবে।
পরীক্ষায় যারা কৃতকার্য হয়েছে, ভালো ফল অর্জন করেছে, তাদের জন্য রইল আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন। তাদের এই সাফল্য কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং সঠিক দিকনির্দেশনার ফসল। তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ আরও মসৃণ হবে এবং তারা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আর যারা কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারেনি, তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এই পরীক্ষার ফলই জীবনের শেষ কথা নয়। তাদের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে পুনরায় প্রস্তুতি নেওয়া এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, জীবনে সফল হওয়ার জন্য ভালো ফলের চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলো দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং হার না মানার মানসিকতা।