একটি পুরনো সিস্টেমের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ন্যায়-ইনসাফ, বৈষম্যহীন ও নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা গণমানুষের আকাক্সক্ষা। সেই গণ-আকাক্সক্ষা ও অভিপ্রায় বাস্তবায়নের সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

চব্বিশের জুলাই ছিল ঐক্যের, বছর না ঘুরতে ২৫ জুলাইয়ে অনৈক্যের দামামা বেজে উঠল। ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই ঐক্যের অংশীজনরা ক্রেডিটবাজি ও একে-অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত। কার অবদান কতটুকু জাতির কাছে তা জাহির করাই যেন তাদের মূল লক্ষ্য! অথচ জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও জুলাই শহীদদের হত্যার বিচার নিয়ে তারা কার্যকর পদক্ষেপ থেকে বহুদূরে। রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের তরুণরা নিজ নিজ প্ল্যাটফর্ম ও কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। অথচ এখনো বহু অবুঝ সন্তান তার শহীদ বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে, এখনো অনেক মা তার সন্তানের লাশ হয়তো গণকবরে আছে- এ আশায় দূর থেকে জিয়ারতে যায়, অনেক বাবা-মা তার ছোট্ট সন্তান হারিয়ে আজো দিশেহারা। এখনো আহত জুলাই যোদ্ধারা সুচিকিৎসার আশায় বুক বেঁধে আছে।

জুলাই যোদ্ধা ও শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি, নেয়া হয়নি পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ। তার ওপর বছর না ঘুরতে মুরু হয়ে গেল বড় ধরনের বিভাজন! কেন ‘রাজাকার’ ট্যাগিং, ‘বাংলা ছাড়’-এর মতো আওয়ামী বস্তাপচা স্লোগান আবার হাজির হলো। সব মিলিয়ে উত্তর খুঁজতে গেলে আবাক হচ্ছে আপামর জনগণ! অনেকের মনে আশঙ্কা আগামীর রাজনীতি আবার সেই পরাজিত দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি না তো! কোনো চক্করে পড়ে কি আবারো দিল্লির ফাঁদে পা দিচ্ছেন একশ্রেণীর রাজনীতিকরা!

গণভবন স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে এটা সত্য; কিন্তু এর শাখা-প্রশাখা ও আগাছা এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখনো সচিবালয় কিংবা সরকারি দফতরে ফ্যাসিবাদের চামচারা ঘাপটি মেরে বসে আছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও সোচ্চার হয়ে উঠেছে পলাতক ফ্যাসিস্টের দোসররা। স্বৈরাচারের বড় দোসররা বিদেশে ভোগবিলাসে জীবন কাটালেও তাদের দেশে থাকা কর্মীদের উসকানি দিয়ে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। আর তাতে ইন্ধন দিচ্ছে রাজনীতিকসহ মহলবিশেষ।

এখনো রাষ্ট্রযন্ত্র ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়নি। এক গোপালগঞ্জে স্বৈরাচারের অনুগতদের নজিরবিহীন তাণ্ডবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সক্ষমতায়ও বড় ধরনের ঘাটতি নজরে এসেছে। ঘটনার পর খোদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেই গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতির কথা স্বীকার করেন। পতিত ফ্যাসিবাদের দোসররা গোপালগঞ্জে যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে পারলে বেশি কার্যকর হতো।

চব্বিশের জুলাই-আগস্ট হয়তো ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটিয়েছে, একটি রেজিমের সমাপ্তি করিয়েছে। হয়তো অতিবাহিত হয়ে যাওয়া একটি বছরে আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। অনেক অপ্রাপ্তি আছে। হতাশা থাকতে পারে; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি একটি সম্ভাবনার শুরু, একটি আকাক্সক্ষার শুভ সূচনা। তাই সব ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ও সীমাবদ্ধতার জায়গাগুলোকে আমলে নিয়ে নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি। অন্যথায় আগামীর বাংলাদেশ আবার পথ হারাবে। তখন সে পথ পুনরুদ্ধারে বড় কণ্টক পথ পাড়ি দিতে হবে। আবারো আমাদের দিল্লির অধিপত্যবাদের কাছে হেরে যেতে হবে। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের আবার গ্রাস করে নেবে।

নতুন বাংলাদেশে আরেকটি কলঙ্ক যুক্ত হয়েছে ‘চাঁদাবাজি’। যা জুলাইয়ের মর্মবাণীকে ম্লান করে দিচ্ছে। নতুন ও পুরনো দল- সবাই এই কলঙ্কের কালি গায়ে মেখেছে। এই কলঙ্কের দায় থেকে মুক্ত হতে শুধু দলের নেতাকর্মীদের বহিষ্কার আর অব্যাহতি দিলেই চলবে না, তথ্য-প্রমাণসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তাদের তুলে দিতে হবে। দ্রুত কঠোর শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে।

সেই সাথে গণ-অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ সব রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের উচিত, যারাই ঐক্য বিনষ্টের স্লোগান তুলবে বা তিক্ত বক্তব্যের ঝড় তুলে ঐক্যের রাজনীতিতে বিভাজনের বিষ ছড়াবে এবং আওয়ামী রাজনীতির বস্তাপচা সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। শুধু চেয়ার ও চেহারার রাজনৈতিক পরিবর্তন গণ-অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার নয়। একটি পুরনো সিস্টেমের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ন্যায়-ইনসাফ, বৈষম্যহীন ও নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা গণমানুষের আকাক্সক্ষা। সেই গণ-আকাক্সক্ষা ও অভিপ্রায় বাস্তবায়নের সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

লেখক : কলামিস্ট

সূত্র, নয়া দিগন্ত