বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও কলেজের করপোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা উচিত। বাজেটে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ, দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিনিয়োগ এবং শিল্পবান্ধব নীতিমালা প্রাধান্য পেলে ২০২৫-২৬ সালে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কারও অপরিহার্য।
একটি অর্থবছর শেষ হতে চলেছে। যা অনেক ঘটনাবহুল, পর্যুদস্ত অর্থবছর। যে অর্থবছরের শুরুতে এ দেশের বিপ্লবী জনগণ বিদায় করেছে স্বৈরাচারী সরকার। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটের অনেক কিছু সংশোধন, বিয়োজন ও সংযোজন করতে হয়েছে। উঠে এসেছে পতিত সরকারের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ভয়ঙ্কর চিত্র। রাজস্বও কাক্সিক্ষত মানে আদায় হচ্ছে না। এ দিকে প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে ২০২৫-২৬ অর্থবছর। পেশ করতে হবে নতুন বাজেট। যে বাজেট ঘিরে রয়েছে অনেক আশা। অন্তর্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট। বাজেটের আকার হতে পারে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা ২ জুন টেলিভিশন ভাষণে বাজেট ঘোষণা করবেন।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় ভাতা কিছুটা বাড়ানো হবে। যদিও রাজস্ব সংগ্রহের বড় কোনো উৎসের সন্ধান না পাওয়ায় আগামী বাজেট তেমন বড় করা হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা কমিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সবার প্রত্যাশা, আসন্ন বাজেট বাস্তবভিত্তিক হবে, উচ্চভিলাষী নয়। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি (নিয়ন্ত্রণকে) প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট করতে যাচ্ছি। এ ছাড়া নজর থাকবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে বাজেটে। চাইব মানুষের জীবনযাত্রা যেন সহজ হয়।’
উন্নয়ন বাজেট : সরকার ব্যয় কমাতে আগামী অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট তথা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি ছিল দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সে তুলনায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপি দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায় নামানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে সরকারের অর্থায়ন ছিল এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের অর্থায়ন কমে এক লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা ও বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নামানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, আগের মতো এবারো অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ আগামী অর্থবছরে কমছে। এ দিকে সবচেয়ে কম বরাদ্দপ্রাপ্ত খাত হলো প্রতিরক্ষা। বাংলাদেশের প্রতি বছরের বাজেটের অঙ্ক বাড়ানোয় এডিপির বড় ভূমিকা থাকে। তবে এবার ব্যতিক্রম হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ : আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯-১০ শতাংশের ঘরে। সূত্রগুলো জানায়, নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ায় এ হার আরো কমবে বলে সরকার আত্মবিশ্বাসী। তবে চ্যালেঞ্জ হলো রাজস্ব আয় বাড়ানো। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে মানুষের ওপর অহেতুক করের বোঝা না বাড়ে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাই সরকারের মূল লক্ষ্য। মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যেই জিডিপির হার কম রাখা হবে। আসন্ন বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করবে। যদিও এডিবি আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের আশপাশে থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ।
বাজেট ঘাটতি কমাতে অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে বাজেট ছোট রাখা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার নিচে থাকলে সাড়ে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।
রাজস্ব আদায় : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে পাঁচ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
জিডিপি : আগামী অর্থবছরের বাজেটে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জিডিপির হার বাড়ানো বা অর্জনকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বিগত সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেশি হলেও এর সুফল সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছেনি। এখন প্রবৃদ্ধি বেশি বা কম সেদিকে নজর নয়, কিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সে জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও বাজেট-ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হবে বলে জানা গেছে। আগামী অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান : বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বলেছে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, এমন বিনিয়োগ আকর্ষণে উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস ও পণ্যের সরবরাহও ঠিক রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প খাতে যেন কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
আসন্ন বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে নিম্নোক্ত কৌশলগুলো গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে : ১. বিনিয়োগবান্ধব কর কাঠামোর ব্যবস্থা করা।
কর হ্রাস : নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও এসএমই খাতে কর হ্রাস বা কর ছুটির ব্যবস্থা করা।
বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) : বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) কর সুবিধা ও সহজ নিয়ম চালু করা।
শিল্প ঋণ সহায়তা : রফতানিমুখী ও উচ্চ-কর্মসংস্থান খাতে স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান।
২. অবকাঠামো উন্নয়ন :
পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) প্রকল্প বৃদ্ধি : পরিবহন, জ্বালানি ও লজিস্টিকসে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।
ডিজিটাল অবকাঠামো : হাইস্পিড ইন্টারনেট ও টেক-হাব তৈরিতে বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত ।
৩. কর্মসংস্থান সহায়তা : দক্ষতা উন্নয়নে যুব ও নারীদের জন্য টেকনিক্যাল এডুকেশন ও ভোকেশনাল ট্রেনিং প্রোগ্রাম জোরদার করা।
স্টার্টআপ ফান্ড : তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য তহবিল ও মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করাও শ্রমঘন শিল্প বিশেষ করে পোশাক, আইটি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও সুবিধা দিতে অগ্রাধিকার দেয়া।
৪. খাতভিত্তিক সহায়তা : কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, সেচ ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণে ভর্তুকির ব্যবস্থা, তৈরী পোশাকের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব কারখানা ও ডিজাইন ইনোভেশনে সহায়তা প্রদান। পাশাপাশি আইটি ও ডিজিটাল ইকোনমি উন্নয়নে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের জন্য ট্যাক্স হোলিডের ব্যবস্থা করা।
৫. সুবিধাজনক নীতি : ব্যবসায়ের সহজতায় লাইসেন্সিং ও নিয়মকানুন সরলীকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। রফতানিতে বৈচিত্র্য আনয়নে নতুন পণ্য ও বাজারে প্রবেশে প্রণোদনার সুযোগ তৈরি করা দরকার। স্থিতিশীল মুদ্রানীতির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া।
৬. সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো ও গরিব ও অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টির বিষয় বাজেটে নির্দেশনা থাকা চাই। নারী শ্রমিকদের জন্য চাইল্ডকেয়ার সাপোর্ট ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করার বিষয় গুরুত্বারোপ করা উচিত। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য জ্বালানি ও পরিবেশ সুরক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদি শিল্পের ভিত্তি তৈরি করা দরকার। বাজেটকে গণমুখী ও বাস্তবতার আলোকে কার্যকর করতে হলে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকায় উন্নীত করা দরকার। মুদ্রানীতির পুনরুদ্ধার এখন নীতিনির্ধারকদের অন্যতম প্রধান কাজ। এটি অর্জনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে। আগামী বাজেটে রাজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত করতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও কলেজের করপোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা উচিত। বাজেটে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ, দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিনিয়োগ এবং শিল্পবান্ধব নীতিমালা প্রাধান্য পেলে ২০২৫-২৬ সালে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কারও অপরিহার্য।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার