ভোট আমি দিলাম, কিন্তু এমপি হবে কে, আমি জানি না! এ এক আজব কথা। নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক অনুশীলন নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত নির্মাণের মৌলিক উপাদান। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন এবং সেই প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার কার্যকারিতা প্রমাণ করে। বাংলাদেশে এক দীর্ঘ ও সংগ্রামময় পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এই নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা ক্রমেই বাড়ছে, তা হলো সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Proportional Representation (PR)। এ পদ্ধতির কিছু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য শুনতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক মনে হলেও, বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক বাস্তবতা, নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এই ব্যবস্থাটি আত্মঘাতী হতে পারে বলেই আশঙ্কা করা যায়।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, গণ অধিকার পরিষদ এবং এনসিপির মতো রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। এটি একদম সুপরিকল্পিত একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। কারণ, এই দলগুলো জানে, জনগণের প্রত্যক্ষ রায়ে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। তাই তারা চাইছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দলকে ভোট দিয়ে সংসদে যাওয়ার পথ খোলা থাকবে; জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না। ভোটার জানবে না, তাঁর ভোটে কে সংসদ সদস্য হবে। এটা এক ধরনের রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি, গণতন্ত্রের মুখোশ পরে জন অংশগ্রহণকে নির্বাসনে পাঠানো। সাংবিধানিকভাবে এখনকার বাস্তবতায় এই পদ্ধতির নির্বাচন একদমই সম্ভব নয়। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন এই সরকারের জন্য সম্ভব হবে না।
পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সংকট হলো, এতে সরাসরি প্রতিনিধিত্বের ধারণা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এখানে ভোটার একজন প্রার্থীকে নয়, একটি দলকে ভোট দেন। ফলে তিনি নিশ্চিত থাকতে পারেন না, তাঁর ভোটে কে সংসদে যাবেন। গণতন্ত্রের প্রাণ হলো স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা। একজন সংসদ সদস্য যখন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন, তখন তিনি সেই এলাকার মানুষের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। উক্ত ব্যবস্থায় এই যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। নির্বাচিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন দলের নিযুক্ত এক প্রতিনিধি, যার দায়বদ্ধতা জনগণের প্রতি নয়, বরং দলীয় প্রধানের প্রতি।
এই পদ্ধতির আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো, জোট সরকার গঠনের আশঙ্কা বৃদ্ধি। কারণ পিআর ব্যবস্থায় সাধারণত কোনো একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। ফলে সরকার গঠনের জন্য দরকষাকষি শুরু হয়, একাধিক দলকে নিয়ে জোট গঠনের প্রয়োজন পড়ে। এর ফলাফল হয় দুর্বল, অস্থির, সিদ্ধান্তহীন সরকার। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল, সংঘাতপ্রবণ দেশে এমন সরকার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা তীব্র হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং প্রতিবেশী আগ্রাসী শক্তিগুলো এমন দুর্বল সরকারকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
পিআর পদ্ধতিতে সংসদে প্রবেশের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় জনপ্রিয়তা নয়, দলীয় আনুগত্য। একজন ব্যক্তি যদি স্থানীয় পর্যায়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়, কর্মক্ষম এবং জনসম্পৃক্তও হন, তবুও তিনি সংসদে যেতে পারবেন না, যদি দল তাকে তালিকায় না রাখে। পক্ষান্তরে, কোনো অযোগ্য, অচেনা, জনবিচ্ছিন্ন, এমনকি বিতর্কিত ব্যক্তিও যদি দলীয় প্রধানের অনুগ্রহভাজন হন, তবে সহজেই তালিকায় স্থান পেয়ে এমপি হতে পারেন। ফলে জনপ্রতিনিধিত্বের ধারণাটিই বিকৃত হয়ে যায়। সংসদ হয়ে ওঠে একটি দলকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ, যেখানে জনগণের প্রত্যাশা, এলাকার সমস্যা বা প্রতিনিধির জবাবদিহিতা গুরুত্ব হারায়। স্থানীয় উন্নয়ন কিংবা জনসম্পৃক্ততা তখন আর সংসদে প্রতিফলিত হয় না, বরং দলীয় অভিপ্রায় ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সেখানে জায়গা করে নেয়।
বর্তমানে যেভাবে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়, তাতে প্রার্থীর যোগ্যতা, জনপ্রিয়তা, নির্বাচনী সম্ভাবনা ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করা হয়। কারণ, দল জানে যে, নির্বাচনে জয়লাভ করতেই হবে, তাই যোগ্য প্রার্থী বাছাই এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে সেই বাধ্যবাধকতা থাকে না। দল চাইলে এমন একজন ব্যক্তিকেও তালিকায় রাখতে পারে, যার জীবনেও কোনো নির্বাচনে জয় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ এখানে জনগণের কাছে ভোট চাইতে হয় না, এলাকায় যেতে হয় না, উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি দিতে হয় না, শুধু দলের প্রধানের অনুকম্পা পেলেই সংসদ সদস্য হওয়া যায়। এভাবে গণতন্ত্রে ‘জনতার প্রতিনিধি’র জায়গায় ঢুকে পড়ে ‘দলের প্রতিনিধি’ এবং জনগণ থেকে সংসদ আরও দূরে সরে যায়। সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো, এই ব্যবস্থায় চরমপন্থি এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোও অন্য ছোট দলের ব্যানারে বৈধভাবে সংসদে প্রবেশ করতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ছোট দলগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও বড় চক্রান্ত প্রায়ই বাস্তবায়িত হয়। চজ ব্যবস্থায় এমন রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি স্বীকৃতির সুযোগ তৈরি হয়, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করবে। এর ফলে সংসদ হয়ে উঠবে একটি আদর্শহীন, বিভক্ত, অনির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক থিয়েটার।
এই ব্যবস্থায় একজন প্রার্থী নির্দিষ্ট কোনো এলাকা প্রতিনিধিত্ব করেন না। ফলে তাঁর কাছে কোনো বিশেষ এলাকার রাস্তা, পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি বা দুর্নীতি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিয়ে জবাবদিহিতা চাওয়া যায় না। সংসদ হয়ে ওঠে এলিট রাজনীতিকদের এক অলীক জগৎ, যেখানে সাধারণ মানুষের স্থান নেই। এলাকার সঙ্গে সংসদ সদস্যের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে জনপ্রতিনিধিত্ব নামক ধারণাটাই ভেঙে পড়ে। এমনকি যারা রাজনীতির নামে ব্যবসা করেন, তারাও এই ব্যবস্থায় সংসদে ঢুকে পড়তে পারবেন। এতে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে এবং জাতীয় নির্বাচন হয়ে উঠবে ‘অযোগ্যদের অভয়ারণ্য’।
এই পদ্ধতির আরেকটি অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো, নির্বাচনের প্রকৃত ফলাফল বিকৃত হওয়ার ঝুঁকি। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল প্রতিটি আসনে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানেও থাকে, তবুও মোট ভোটসংখ্যার ভিত্তিতে তারা একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পেয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, কোনো দল যদি ভোটের হিসাবে ৩০০ আসনের প্রতিটিতে জিতে যায়, তবুও তালিকাভিত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা সব সংসদ সদস্য বসাতে পারবে না। অর্থাৎ জনগণ একটা এলাকায় যেই দলকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে, সেই এলাকায় সেই দলের প্রার্থী নাও সংসদ হতে পারে, এটা গণতন্ত্রের নামে একটি পরিহাস।
পিআর ব্যবস্থার অদ্ভুত আরেক দিক হলো, কিছু মানুষ একদিকে নারীদের সংরক্ষিত আসন বাদ দিয়ে সরাসরি নির্বাচনের দাবি করেন, অন্যদিকে সংসদ সদস্য হতে চান দলীয় প্রধানের তালিকাভুক্তির মাধ্যমে। এই দ্বিচারিতা গণতন্ত্রের অপমান। এখানে নির্বাচনী যোগ্যতা মুখ্য হবে, দলীয় আনুগত্য ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর সঙ্গে যোগাযোগই হয়ে ওঠে মূল নিয়ামক।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সুবিধাভোগী শক্তিগুলো ‘ক্যাবিনেট সরকার’ গঠনের নামে নতুন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। একটি নিবন্ধিত ছোট দলকে সামনে রেখে তাঁদের লোকজনকে তালিকায় স্থান দিয়ে সংসদে পাঠানো সম্ভব হবে। ভারতের ভূরাজনৈতিক নকশার প্রেক্ষাপটে এই ব্যবস্থা একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ বলেই অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
বাংলাদেশে যে সংকট বিদ্যমান, তা কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচন পদ্ধতির কারণে নয়, বরং পদ্ধতির প্রয়োগ ও নির্বাচনকালীন পরিবেশের ব্যর্থতার জন্য। তাই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনকালীদ সরকারের নিরপেক্ষতা, সেনা মোতায়েনসহ নির্ভেজাল নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা; প্রযুক্তিনির্ভর এবং স্বচ্ছ ভোট পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া, গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের পূর্ণ স্বাধীনতা। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন মানে কেবল পদ্ধতির পরিবর্তন নয়, বরং সেই পদ্ধতির বাস্তবায়নের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা।
সবশেষে বলা যায়, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা গণতন্ত্রের নামে এক বিভ্রান্তিকর ফাঁদ। এই পদ্ধতি দলীয় কর্তৃত্ববাদকে আরও শক্ত করবে, চরমপন্থাকে বৈধতা দেবে, এবং জনগণ থেকে সংসদকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এই পথে হাঁটা মানে শুধু গণতন্ত্র নয়, আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতির ভবিষ্যৎকেও চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া। একে গণতন্ত্রের প্রগতি নয়, বরং অবনতি বলেই বিবেচিত হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।