গত শনিবার বেলা সোয়া দুইটার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে (পণ্য রাখার স্থান) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কার্গো ভিলেজের যে অংশে আগুন লাগে, সেখানে আমদানি করা পণ্য রাখা হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেখানে আমদানিকৃত কেমিক্যাল মজুত রাখা হয়, সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, আনসার ও পুলিশের প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ৭ ঘন্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নেভাতে গিয়ে আনসার সদস্যসহ ৩৫ জনের মতো আহত হয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিমানবন্দরে বিমান উঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময়ে ২৩টি আন্তর্জাতিক বিমান অন্য বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এতে ভোগান্তিতে পড়েন শত শত বিমানযাত্রী। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে রাত ৯টা থেকে আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল শুরু হয়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অন্তর্বর্তী সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সাংদিকদের বলেন, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ও আগুন লাগার কারণ কি, তা তদন্ত করা হবে। পরবর্তীতে রাতে অগ্নিকা-ের কারণ অনুসন্ধান ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত রির্পোট জমা দিতে বলেছে।
বিমানবন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকা-সহ এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর শিয়ালবাড়িতে একটি গার্মেন্ট কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে প্রায় ২০ জনের মতো মৃত্যু হয়। গত বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে চট্টগ্রামের ইপিজেডে অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিক্যাল কোম্পানির গুদামে আগুন লাগে। এরপর গত শনিবার শাহজালাল বিমানবন্দরে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ধারাবাহিকভাবে এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো কি নাশকতা, ষড়যন্ত্র, নিছক দুর্ঘটনা নাকি অবহেলা, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা তা খতিয়ে দেখতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, গত কয়েক দিনে স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী একাধিক পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, দুই সপ্তাহ আগেই গোয়েন্দারা একটি বিমানবন্দরে নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে সিভিল এভিয়েশনসহ সকল বিমানবন্দরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সতর্ক চিঠি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, গোয়েন্দাদের এই সতর্কতামূলক চিঠির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে শাহজালালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এই অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এতে পোশাক শিল্পের বিদেশি অর্ডার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ, পুড়ে যাওয়া মালামালের মধ্যে বায়ারদের অর্ডারের সেম্পলসহ রপ্তানির পোশাক রয়েছে। আমরা দেখেছি, গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দিতে এবং দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পতিত আওয়ামী লীগও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানায় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার দাবিতে আন্দোলনের নামে কারখানায় অগ্নিকা-সহ নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায়। ফ্যাসিস্টের দোসর গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা ইচ্ছাকৃতভাবে গ-গোল লাগিয়ে কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের উসকে দেয়। সরকার সেসব আন্দোলন সামাল দিতে সক্ষম হলেও পতিত আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। সে দেশের এক নম্বর রপ্তানি খাত গার্মেন্টকে টার্গেট করে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, নাশকতা ঘটিয়ে দেশকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে তুলতে পতিত আওয়ামী লীগ ও ভারত সক্রিয়ভাবে মাঠে নেমেছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, তা বানচালে এই চক্র ততই সক্রিয়তা দেখাচ্ছে। গত কিছুদিন ধরেই কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মাধ্যমে নাশকতার হুমকি দিয়ে আসছে। তাদের এ হুমকি যে অমূলক নয়, তা একের পর এক অগ্নিকা-ের ঘটনা সেই ইঙ্গিত দেয়। প্রশাসনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পতিত আওয়ামী লীগের লোকজন ঘাপটি মেরে বসে আছে, এ সংবাদ পত্রপত্রিকায় বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের পুরোপুরি সরাতে সক্ষম হয়নি। ফলে তাদের দ্বারা ষড়যন্ত্র হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও ভারত মিলে বানচালের চেষ্টা করবে এটা জানা কথা। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, দেশের কিছু রাজনৈতিক দল, সরকারে থাকা কিছু উপদেষ্টা এবং তাদের অনুসারি বিদেশে থাকা কিছু ইউটিউবারও নির্বাচন যাতে পিছিয়ে যায় এ ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ, ভারত ও দেশের কিছু রাজনৈতিক দল, উপদেষ্টা এবং তাদের অনুসারিরা নির্বাচন বানচালের যে অপকর্ম করছে, তা একসূত্রে গেঁথে যাচ্ছে। এতে তাদের লাভ থাকলেও দেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি। বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অগ্নি নির্বাপনে বাংলাদেশের সক্ষমতার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কারণ, বিমানবন্দরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় যে ধরনের শক্তিশালী অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা থাকা জরুরি, তার অভাব রয়েছে। তা নাহলে, দীর্ঘ সাত ঘন্টা ধরে আগুন জ্বলতে পারে না।
দেশে প্রায় প্রতিবছরই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মানুষের যেমন জীবন যায়, তেমনি সম্পদেরও বিপুল ক্ষতি হয়। বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা শুষ্ক মৌসুমে ঘটে। ইতোমধ্যে শুষ্ক মৌসুম শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে, সকলের সতর্ক থাকা জরুরি। তবে অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পেছনে প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে যায়। ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটলে সরকারের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে বিগত বছরগুলোতে যেসব ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটেছে, তার তদন্ত প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। নিমতলী, চকবাজারের চুড়িহাট্টা, কাচপুরের জুস ফ্যাক্টরি ট্র্যাজেডির মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ এবং কারা দায়ী তা উদ্ঘাটন করা যায়নি। শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকা- নিয়ে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। আমরা আশা করি, সরকার অগ্নিকা-ের ঘটনা যথাযথ তদন্ত করে প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করবে। এতে যদি নাশকাত বা ষড়যন্ত্র থাকে এবং এর সাথে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে দ্রুততম সময়ে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। সময়ক্ষেপণ করে তা ধামাচাপা দেয়ার অপসংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।