ডাকসু, জাকসু, চাকসু এবং রাকসু ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলগুলো ভূমিধ্বস বিজয় লাভ করেছে। গত মাসে ঢাকসু এবং জাকসুর নির্বাচন হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ২৮টি পদের মধ্যে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ২৬টি, ১৩ সেপ্টেম্বর জাকসু নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে ২০টি, গত ১৫ অক্টোবর চাকসু নির্বাচনে ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টি এবং গত ১৬ অক্টোবর রাকসু নির্বাচনে ২৩টি পদের মধ্যে ২০টি পদে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের বিজয় মানে ছাত্রশিবিরে বিজয়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠনটির এই ‘ক্লিন সুইপ’ বিজয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তার এ বিজয় অনাকাক্সিক্ষত বা হঠাৎ বিজয় নয়। এটি একটি সুশৃঙ্খল ও মেধাভিত্তিক ছাত্রসংগঠনের বিজয়। আমরা ছাত্রশিবির সমর্থিত বিজয়ীদের অভিনন্দন জানাই। অন্যদিকে, ছাত্রদলের ভরাডুবি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির কেন এই ভরাডুবি হয়েছে, তা নিয়ে দলটির যেমন আত্মানুসন্ধান জরুরি, তেমনি দলটির মাতৃ রাজনৈতিক দল বিএনপিরও ভাবনার বিষয় রয়েছে।
ছাত্রশিবির বরাবরই একটি সুসংগঠিত ও মেধাভিত্তিক সংগঠন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করে তার প্রতি আকৃষ্ট করার বহুমুখী প্রয়াস সে চালায়। সে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, কেন ছাত্রশিবিরকে সমর্থন করতে হবে। শুধু তাই নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনের ভাষা বুঝে সংগঠনটি সে অনুযায়ী, তাদের পাশে দাঁড়ায়। মূলত সংগঠনটির সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা ও শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি তার বিজয়কে সুনিশ্চিত করে। গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গত এক বছরে ছাত্রশিবির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। তাদের সমস্যা ও সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করেছে। এর ফলাফল হিসেবে ছাত্রসংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। সংগঠনটির এ বিজয়, তার কাজের বিজয়। সে ছাত্র রাজনীতি করে জিতেছে। তার রাজনীতি শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করে জিতেছে। অন্যদিকে, ছাত্রদল এ কাজগুলো করতে পারেনি। তারপরও তারা যে ফলাফল করেছে, তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বলা বাহুল্য, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে ক্যাম্পাসগুলো থেকে ছাত্রদল বিতাড়িত ছিল। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই দেয়নি। নানা নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদলকে পর্যুদস্ত হতে হয়েছে। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হয়েছে। হাসিনার পতনের পর দীর্ঘ এই দেড় দশকের ট্রমা থেকে সংগঠনটি বের হতে পারেনি। গুছিয়ে উঠতে পারেনি। তার অভিভাবক বিএনপি থেকেও তেমন সমর্থন পায়নি। উল্টো দলের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর সাম্প্রতিক অপকর্ম ও দুর্নামের প্রভাব ছাত্রদলের ওপর পড়েছে। এর বিপরীতে ছাত্রশিবির বিগত দেড় দশকে কৌশল অবলম্বন করে ক্যাম্পাসগুলোতে গোপনে রাজনীতি করে গেছে। তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। হাসিনার পতনের পর তারা প্রকাশ্যে এসে নতুন উদ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করার বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করেছে এবং ছাত্রসংসদ নির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফলাফল পেয়েছে। সংগঠনটির সঠিক উদ্দেশ্য এবং এ অনুযায়ী তার ইতিবাচক কর্ম তাকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। নির্বাচনগুলোতে ছাত্রদলের পরাজয়ের কারণ হিসেবে নানা অজুহাতের কথা বলা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচন করার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা প্রয়োজন ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করার পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল, সংগঠনটি তা নিতে পারেনি। লক্ষ্য অর্জনে যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতিই তার ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ। এক্ষেত্রে, প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনীতিতে যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, তাতে নেগেটিভ রাজনীতি মানুষ এখন আর পছন্দ করছে না। মানুষের এই মন না বুঝে নেগেটিভ রাজনীতি ও কর্মকা- করলে যে, বিপর্যয় হতে পারে, তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচনগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে এবং তা আগামীর রাজনীতি কেমন হতে পারে, তার ইঙ্গিতও দিয়েছে। আমরা দেখেছি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের মেধাহীন ও ক্যাডারভিত্তিক নেগেটিভ রাজনীতিতে আচ্ছন্ন ছিল। সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোতে হেন কোনো অপরাধ নেই, যা করেনি। তার মাদার অর্গানাইজেশন কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ এসব অপকর্ম প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। মেধাহীন ও সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্র রাজনীতিকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাসের হার বাড়িয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে অলীক কৃতিত্ব নিয়েছে। এতে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন না হয়ে সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এসব সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই সম্পদ না হয়ে দেশের সংকটে পরিণত হয়েছে। গত এক বছরে অনুষ্ঠিত এসএসসি ও এইইচএসসি পরীক্ষায় প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশ করা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার কীভাবে শুধু কৃতিত্ব নেয়ার জন্য পাসের হার বেশি দেখিয়ে শিক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্মোহভাবে শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন করা হয়েছে। মেধাবীরা যেমন ভাল ফলাফল করেছে, তেমনি যারা পড়াশোনা ঠিকমতো করেনি, তারা ফেল করেছে। সরকার কৃতিত্ব নেয়ার জন্য পাশের হার বেশি দেখায়নি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররাজনীতিকে তারুণ্যের রাজনীতি বলা হয়। এখান থেকে ভবিষ্যত রাজনীতিবিদের জন্ম হয়। মেধাবীরা রাজনীতিতে যুক্ত হয়। তবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে ক্যাম্পাসগুলোকে নেগেটিভ পলিটিক্সের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছিল। তার পতনের পর ক্যাম্পাসে সুস্থ রাজনীতি গতি পেয়েছে। এ গতি কাজে লাগিয়ে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলগুলো বিপুল বিজয় লাভ করেছে। ছাত্রদল এ কাজটি যথাযথভাবে করতে পারেনি বলে, আশানুরূপ ফল পায়নি। এ থেকে সংগঠনটির যেমন শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়েছে, তেমনি এ শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আগামীতে পজেটিভ ও মেধাভিত্তিক রাজনীতিতে তাকে মনোযোগী হতে হবে। নেতিবাচক রাজনীতি থেকে বের হয়ে ইতিবাচক রাজনীতি ধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে মেধার বিজয় হয়েছে। ছাত্রশিবির এ কাজটি যথাযথভাবে করতে পেরেছে বলে তার কাক্সিক্ষত বিজয় এসেছে। আমরা আশা করি, ছাত্র সংসদে ছাত্রশিবিরের যে নেতৃত্ব এসেছে, তারা ক্যাম্পাসে এই মেধাকে গুরুত্ব দিয়ে তার বিকাশে কাজ করবে। ক্যাম্পাসে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভূমিকা পালন করবে।