পাহাড়ি ও সমতলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় ২০১৭ সালে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রী।

পাহাড়ি ও সমতলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় ২০১৭ সালে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রী। তিন পার্বত্য জেলা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাথমিকে পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা প্রতি বছর তাদের মাতৃভাষার নতুন পাঠ্যবই পাচ্ছে। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শেখানোর উদ্যোগটি প্রশংসনীয় ছিল। যুগোপযোগী পরিবেশের অভাব ও শিক্ষক সংকটে উদ্যোগটি কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এ উদ্যোগের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনার অভাবে নিজেদেরই প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারছেন না শিক্ষকরা। নিজস্ব ভাষায় পাঠদানের জন্য প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক আলাদা শিক্ষক নিয়োগ। কিন্তু বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক সংকট মারাত্মক প্রকট। বিদ্যমান সংকটগুলো নিরসন না করেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে নতুন উদ্যোগ। সহজে পাঠযোগ্য করতে পাঁচ ভাষার এসব বইয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর যুক্ত করবে বাংলা অনুবাদ ও উচ্চারণ নির্দেশিকা। শুধু উদ্যোগ নিলেই হবে না, মাতৃভাষা শিক্ষা এগিয়ে নিতে হলে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনার পাশাপাশি শিক্ষক সংকট নিরসনও জরুরি। বিদ্যমান সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে আগে তা সমাধান করা উচিত। অর্থাৎ শিক্ষকের সংকট নিরসন না করে নতুন উদ্যোগেও সাফল্য পাওয়া কঠিন হবে।

সরকার প্রথম পর্যায়ে যে পাঁচ ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে তার মধ্যে দুটি সমতলের (গারো ও সাদ্রী) এবং তিনটি পার্বত্য অঞ্চলের। শিক্ষক সংকট রয়েছে দুই অঞ্চলেই। পাহাড়ে শিক্ষক সংকট মূলত পদায়নে। সংখ্যাগত দিক দিয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষার পর্যাপ্ত শিক্ষক এখানে থাকলেও যে ভাষার শিক্ষক যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সে ভাষার শিক্ষক নেই। যেমন চাকমা স্কুলে মারমা শিক্ষক, মারমা স্কুলে ত্রিপুরা শিক্ষক, ত্রিপুরা স্কুলে চাকমা শিক্ষক অথবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাভাষী শিশুদের স্কুলে বাঙালি শিক্ষক। সমতলের ক্ষেত্রে সংকটটি ভিন্ন মাত্রার। গারো ও সাদ্রী ভাষাভাষী এলাকার স্কুলগুলোয় এ দুই ভাষার শিক্ষক নেই বললেই চলে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি দৃশ্যমান হয়নি।

একেকটি এলাকায় ভিন্ন ভাষার শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু একসঙ্গে একাধিক ভাষায় দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে বিদ্যালয়গুলোয়। আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষকরা নিজস্ব ভাষায় পড়াশোনা না করায় নিজেরাও শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পারছেন না। এ কারণে প্রতি বছর বই বিতরণ করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এসব বই রেখে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা আগের মতোই বাংলা ভাষার বইয়ের মাধ্যমে পড়াশোনা করছে বলে বণিক বার্তার প্রতিবেদন উঠে এসেছে। বাস্তবায়নের সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ না করায় বিপুল ব্যয়ে নেয়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কার্যক্রমটি কয়েক বছরের মধ্যেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ শিক্ষক স্বচ্ছন্দে শোনা-বলার দক্ষতা রাখলেও মাতৃভাষায় পড়া ও লেখার দক্ষতা নেই। আবার এক বিদ্যালয়ে একাধিক ভাষার শিক্ষার্থী থাকলেও সেই অনুযায়ী ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় পাঠদানের যে উদ্দেশ্য ছিল, তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ঠিকঠাকভাবে হচ্ছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী শিক্ষক না থাকায় বইগুলো পাঠদানে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রের ব্যয়বহুল উদ্যোগটি শিক্ষার্থীদের উপকারে আসেনি, বরং গৃহীত নীতির বাস্তবায়ন-দুর্বলতাই দৃশ্যমান হয়েছে।

সংকট উত্তরণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় ছাপানো বইগুলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান নিশ্চিত করতে পাঠ্যবই প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট ভাষার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্ত করা হবে বাংলায় বর্ণ, শব্দ ও উচ্চারণ এবং অনুবাদ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর থেকে পরিমার্জিত এসব নতুন পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হবে। এ উদ্যোগ সময়োচিত ও বাস্তবমুখী হলেও এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা শিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রথমত, মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীরা বাংলার ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে, যা ধীরে ধীরে তাদের মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলা অনুবাদ যুক্ত থাকার ফলে শিক্ষকরা নিজ ভাষা শেখানোর পরিবর্তে শুধু অনুবাদই ব্যাখ্যা করতে উৎসাহী হতে পারেন, ফলে মাতৃভাষাভিত্তিক পাঠদান পরোক্ষভাবে উপেক্ষিত থেকে যাবে। তৃতীয়ত, এ মিশ্র পাঠ্যবই ব্যবস্থায় ভাষাগত বিভ্রান্তি ও দ্বৈধতা তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের শুরুতে শেখার সময় যে একাগ্রতা ও নিরবচ্ছিন্ন ভাষা-পরিবেশ প্রয়োজন, তা ব্যাহত হতে পারে। এ উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় ভাষাভাষী শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে ব্যাহত করতে পারে। আর অনুবাদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়লে স্থানীয় ভাষায় দক্ষ শিক্ষক তৈরির প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব হারাতে পারে। তাই উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে এর সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করাই হবে বাঞ্ছনীয়।

মাতৃভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শুধু পাঠ্যবই পরিমার্জনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ভাষাভিত্তিক দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ। স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করতে হবে। বই সরবরাহের পর সেগুলোর ব্যবহার ও পাঠদানের গুণগত মান পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা শুধু সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্ন নয়, বরং এটি একটি শিশুর শিখনক্ষমতা ও পরিচয় বিকাশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তাই পরিকল্পনার পাশাপাশি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে আন্তরিকতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করলেই এ উদ্যোগ সফল হতে পারে।

সূত্র, বণিক বার্তা