দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৭৫ শতাংশ নিজস্ব উৎসনির্ভর ও ২৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর। গ্যাস আমদানি করতেই ৪০-৪৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। অন্যদিকে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সরকার বরাদ্দ রাখে নামসর্বস্ব। এ অর্থ দিয়ে গ্যাস খাতের সংকট যেমন কাটানো সম্ভব নয়, তেমনি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও দুরূহ ব্যাপার। দেশের জ্বালানি খাতের স্থিতিশীল ও টেকসই সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের উত্তোলন ও সরবরাহ বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দরকার এ খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে এ খাতের উপকরণ বিশেষত রিগ, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব। সরকার যতটুকু বিনিয়োগ করছে তা দেশের গ্যাস খাতে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। সুতরাং বিনিয়োগ বাড়িয়ে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের মাধ্যমেই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
গ্যাসের নতুন মজুদ বাড়ানো এবং গ্রিডে সরবরাহ বাড়াতে স্থলভাগে ডিপ ড্রিলিংয়ে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। এটি সরকারের প্রথম বড় কোনো উদ্যোগ। মোট চারটি গভীর কূপ খননের মধ্যে দুটি এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়েছে। তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ডে গভীর কূপ খনন প্রকল্পটি পাস হয়েছে গত রোববার। প্রয়োজনীয় কাজ শেষ হলে আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ তিতাস-৩১ কূপ খননের মধ্য দিয়ে শুরু হবে ডিপ ড্রিলিংয়ের কাজ। পরবর্তী সময়ে খনন করা হবে বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ডের ১১ নম্বর কূপ (বাখরাবাদ-১১), শ্রীকাইল-১ ও মোবারকপুর-১। দেশে গ্যাসের নতুন মজুদ বৃদ্ধি এবং গ্রিডে সরবরাহ বাড়াতে পেট্রোবাংলা স্থলভাগে গভীর কূপ খনন করবে। একনেকে পাস হওয়ায় এখন কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় কোম্পানি নির্বাচন করা হবে। বেশ কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি দরপত্র জমা দিয়েছে। সে কার্যক্রম শেষে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আনতে আরো অন্তত দুই-তিন মাস সময়ের প্রয়োজন। সব মিলিয়ে চলতি বছরের শেষ নাগাদ এসব প্রকল্পের ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। প্রকল্পের আওতায় তিতাস-৩১ ও বাখরাবাদ-১১ কূপের গভীরতা যথাক্রমে ৫ হাজার ৬০০ ও ৪ হাজার ৩৬০ মিটার। কারিগরি কমিটি ও বিদেশী পরামর্শকদের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিদিন আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে তিতাস থেকে এবং বাখরাবাদ থেকে ১০ মিলিয়ন ঘনফুট।
গ্যাস দেশের নিজস্ব সম্পদ। স্থলভাগে ও সমুদ্রে এ গ্যাস আছে। অথচ বিগত সরকারের আমলে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কার্যকর ভূমিকা না নিয়ে ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগীদের স্বার্থে গ্যাস খাতকে আমদানিনির্ভর খাতে পরিণত করা হয়েছে। বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর বিপরীতে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ না থাকায় স্থানীয় সরবরাহ নিয়মিত কমছে। ফলে ঘাটতি পূরণে চড়া দামে বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। উত্তোলন কমতে থাকলে আমদানি আরো বাড়তে থাকবে। এ পরিস্থিতি সামলাতে দেশে গ্যাসের স্থানীয় সরবরাহ বাড়াতে ডিপ ড্রিলিংয়ে যাচ্ছে সরকার। যেহেতু গ্যাসের ওপরই নির্ভরশীল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো, তাই চলমান গ্যাস সংকট সমাধানে অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব দিতে হবে।
গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ গতিশীল করা দরকার। বাস্তবতা হলো দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি। বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় মিয়ানমারের। এরপর ২০১৩ সালে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে দেশটি। এরপর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয় ২০১৪ সালে। জলসীমার আইনি মীমাংসার পর থেকে মিয়ানমার ও ভারত বঙ্গোপসাগরে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তারা এক্ষেত্রে সফলতাও পেয়েছে। এরই মধ্যে এ নিষ্পত্তিরও দীর্ঘ সময় পেরিয়েছে। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে কোনো সাফল্যেরই দেখা পায়নি বাংলাদেশ। এমনকি সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের জন্য দরপত্র আহ্বান করলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে হবে। এজন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও জাতীয় সক্ষমতা উভয়ই বাড়াতে হবে। জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া ঠিক নয়। আমদানিনির্ভরতা কমাতে গ্যাসসহ নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। দেশীয় উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্বালানি ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের গ্যাসের সরবরাহ। স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান আসায় স্বল্প মূল্যে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে এটি প্রদান করা গেছে। এতে স্বল্প মূল্যে পণ্য উৎপাদন করা গেছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। জ্বালানি তেলের সঙ্গে এলএনজির দামও বাড়ছে। আগামীতে আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্ধারিত সময়ে চালু করা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজার সবসময়ই দোদুল্যমান। ফলে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমদানিনির্ভরতা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। বাংলাদেশে জল ও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বেশি জোর দেয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকে বলে আসছেন, আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাত গড়ে তোলা হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটিই ঘটেছে মূলত দেশের জ্বালানি খাতে। টেকসই ও নিরাপদ জ্বালানি খাত গড়ে তুলতে হলে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বিকল্প নেই। দেরিতে হলেও পেট্রোবাংলা দেশের স্থলভাগে ডিপ ড্রিলিংয়ে যাচ্ছে। গভীরে কূপ খনন করে বড় আকারের গ্যাস পাওয়া গেলে তা দেশের জ্বালানি খাতের নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখবে। স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। এর মাধ্যমে এ খাতে প্রযুক্তির আধুনিকায়নসহ দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এটি করা না গেলে স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলন বাড়বে না, গ্যাসের ঘাটতিও নিকট ভবিষ্যতে কমবে না।