গত শুক্রবার রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ নামে এক ব্যক্তিকে। হত্যার আগে তাকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে কেউ কেউ লাফায়। এই বর্বরতম হত্যাকা-ের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে মানুষের মধ্যে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে একে মধ্যযুগীয় বর্বরতার সাথে তুলনা করেন। এ ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের স¤পৃক্ততার কথা জানা গেছে। এই তিন সংগঠনই খুনের সাথে সম্পৃক্তদের তৎক্ষণাৎ আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। মামলার তদন্তকারী ও স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানা গেছে, হত্যাকা-ের পেছনের মূল কারণ চাঁদাবাজি। পুলিশ বলেছে, নিহত লাল চাঁদ একসময় যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হত্যার ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। এতে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ১৫-২০ জনকে। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাব চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গতকাল সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে জানিয়েছেন, এ হত্যা মামলা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে। মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকা-ের দ্রুত বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২-এর ধারা ১০- এর অধীন দ্রুততম সময়ে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। গত শুক্রবার রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি শুধু একটি প্রাণনাশের ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। এই ধরনের নির্মম ঘটনা একটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং তা বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর করছে। তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও নীতির সঙ্গে সন্ত্রাস ও সহিংসতার কোনো স¤পর্ক নেই। অপরাধী যেই হোক না কেন, সে কখনোই আইনের ঊর্ধ্বে হতে পারে না।

গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তারা যেন ক্ষমতায় এসে গেছে। এই মনোভাব নিয়ে দলটির একশ্রেণীর নেতাকর্মী ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধ দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব নেতাকর্মীর অপকর্মের দায় বিএনপির উপর এসে পড়ছে। হাসিনার পতনের পর থেকেই দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বারবার কঠোর বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অপকর্মে জড়িত দলের প্রায় সাড়ে চার হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছে। দলের এমন কঠোর অবস্থান থাকা সত্ত্বেও দলের অনেক নেতাকর্মী এখনো সতর্ক হয়নি, শিক্ষা নেয়নি। উল্টো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারই নৃশংস প্রকাশ ঘটেছে মিটফোর্ডের ঘটনার মধ্য দিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কেন বেপরোয়া হয়ে ওঠা নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? পর্যবেক্ষকদের মতে, দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা একশ্রেণীর নেতাকর্মী তোয়াক্কা করছে না। দলের অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তারা স্থানীয়ভাবে নেতাকর্মীদের সতর্ক ও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এলাকায় কারা অপকর্মের সাথে জড়িত, তা তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ফলে ঘটনা ঘটার আগে তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এমনকি হাইকমান্ডের নির্দেশনাও প্রতিপালন করছে না। ঘটনা ঘটার পর বহিষ্কার করছে। বিএনপির কিছু নেতাকর্মীর এই অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা পুরো দলের ইমেজ সাধারণ মানুষের কাছে যেমন ক্ষুণœ করছে, তেমনি তার প্রতিপক্ষের হাতে সমালোচনার অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলটির ফলাফলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেসব নেতাকর্মী ক্ষমতায় এসে গেছি মনে করে অপকর্মে জড়াচ্ছে, তাদের সে স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়ে যেতে সময় লাগবে না। বলা বাহুল্য, বিএনপি কোনো বিপ্লবী বা রেজিমেন্টেড দল নয়। এটি সাধারণ মানুষের পপুলার ভোট বা সমর্থনভিত্তিক দল। নির্বাচনের মাধ্যমেই তাকে ক্ষমতায় যেতে হবে। ফলে দলের নেতাকর্মীদের যেকোনো ধরনের অপকর্ম সহজেই তার পপুলার বা পজেটিভ ভোটকে নেগেটিভ করে দিতে পারে। ইতোমধ্যে যেসব নেতাকর্মী অপকর্ম করে দলের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করেছে, সেসব ঘটনা আগামী নির্বাচনে যে তার বিরোধী পক্ষরা প্রচার করার জন্য শানিয়ে বসে আছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে। বিশ্বাসযোগ্য এসব ঘটনা তখন দল কিভাবে মোকাবেলা করবে, কি জবাব দেবে, তাই দেখার বিষয়। বিএনপির মূল শক্তি তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সততা। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে কতটা সৎ ও নির্লোভ জীবনযাপন করতেন, তা তার মৃত্যুর পর ছেড়া গেঞ্জি ও ভাঙ্গা স্যুটকেস দেখা থেকেই দেশের মানুষ জানতে ও বুঝতে পেরেছে। তার সততাপূর্ণ সাধারণ জীবনযাপনের ওপর ভিত্তি করেই বিএনপি গড়ে উঠেছে। জনগণের বিপুল সমর্থন পেয়েছে এবং পাচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা একের পর এক দুর্নীতির মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দিয়ে ফরমায়েসি সাজা দিলেও দেশের মানুষ তা বিশ্বাস করেনি। হাসিনার পতনের পর আদালতে এসব মমালা যে মিথ্যা ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছেই তিনি অত্যন্ত প্রিয় এবং সততার প্রতীক হয়ে আছেন। জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার এই সৎ, নির্লোভ জীবন এবং দেশপ্রেমই বিএনপির মূল ভিত্তি, আদর্শ ও শক্তি। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী তাদের এই শক্তি ধারন করতে পারেনি। পারেনি বলেই নানা অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে। মিটফোর্ডের ঘটনার মতো নির্মম ও নির্দয় ঘটনা ঘটাচ্ছে। এরা কোনোভাবেই জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার আদর্শের হতে পারে না। একই দিনে (গত শুক্রবার) খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক এক নেতাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যার সাথে কারা জড়িত, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রগ কেটে হত্যা নিশ্চিত করার এ ধরনের ঘটনা অতীতেও অনেক ঘটেছে। কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটায় তা সাধারণ মানুষ জানে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন করে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে অনেক নৃশংস হত্যাকা- দেখেছি। বিচারবর্হিভূত নৃশংস হত্যাকা- ছিল নিয়মিত ঘটনা। এসব ঘটনা এখন প্রকাশিত হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের কথা কেউ ভুলে যায়নি। কিংবা কক্সবাজারে মেয়েকে ফোনে রেখে বাবা একরামকে পুলিশের গুলি করে হত্যার মতো নির্মম ঘটনা এখনো তরতাজা হয়ে আছে। সাত খুনের মামলার বিচার সম্পন্ন হলেও তাদের সাজা এখনো কার্যকর হয়নি। একরাম হত্যার বিচারও শেষ হয়েছে। এসব সাজা কার্যকর না হওয়ায় অপরাধীরা উৎসাহী হচ্ছে। সাজা কার্যকর হলে, অপরাধীদের মধ্যে যেমন ভীতি সঞ্চার হবে, তেমনি অপরাধ প্রবণতাও কমে আসবে। অতীতের চাঞ্চল্যকর এসব অপরাধের সাজা দ্রুত কার্যকর হওয়া এবং মিটফোর্ডের হত্যাকা-ের বিচার ও সাজা দ্রুত করা অপরিহার্য।

বিএনপির একশ্রেণীর নেতাকর্মীর অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আরও বেশি ‘রুথলেস’ হওয়া জরুরি। যারা দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনার অন্তরায় হয়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ড্রাস্টিক অ্যাকশন নিতে হবে। অপকর্মের সাথে যুক্ত হাজার হাজার নেতাকর্মী দল থেকে বহিষ্কার করার পরও কেন তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে হবে। কোথায় ব্যর্থতা, কারা দলের হুঁশিয়ারি ও চেইন অফ কমান্ড মানছে না, কারা এসব অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। যেসব এলাকার নেতাকর্মী অপকর্ম করছে, সেসব এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের এ ব্যাপারে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। দলে কোনো হাইব্রিড নেতাকর্মী ঢুকে স্যাবোটাজ করছে কিনা, এদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে মিটফোর্ডের নৃশংস হত্যাকা-ের বিচার দ্রুত আইনে দ্রুত শেষ করতে হবে। আসামীদের সাজা দ্রততম সময়ে নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ ধরনের নৃশংস ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারেরও ব্যর্থতার দিকটি তুলে ধরে। পুলিশের পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনের দুর্বলতারও প্রকাশ ঘটায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তার দায়িত্ব ও নীতির মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে। কে কোন দলের, এ বিবেচনা বা মনোভাব থেকে বের হয়ে অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করতে হবে। এক্ষত্রে কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই।

সূত্র, ইনকিলাব