ইতিহাসের নান্দিপাঠ বারবার তার সুর বদলায়। ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কুশীলবরা জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে নিজেদের কায়েমি স্বার্থে পূর্বের সব প্রত্যাশা ভন্ডুল করে নতুন বয়ান হাজির করে। জনগণের বঞ্চনাবোধ সৃষ্টি হতে কিছুটা সময় নেয়। এরপর আবারো যুদ্ধ-সংগ্রামে অনেক রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি স্বপ্ন নতুন অভিযাত্রায় সামিল হয়। পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতা হারানোর এক শতাব্দী পর বাংলার সিপাহী জনতা ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বিদ্রোহ করে বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বজ্রমুষ্টি অনেকটা ধসিয়ে দিতে সক্ষম হলেও হাজার হাজার সিপাহী, ফকির ও আলেমের রক্তের উপর বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি নতুন বন্দোবস্ত হাজির করে। নতুন পুলিশ অধ্যাদেশ পেনাল কোড, সিভিল প্রসিডিউর জারির সাথে সাথে এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও সম্প্রীতির হাজার বছরের ঐতিহ্যের বিপরীতে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির মধ্য দিয়ে সবকিছু নিজেদের আয়ত্বে নিতে সক্ষম হয়। পারস্য, তুরস্ক ও আফগানিস্তান থেকে আগত সুলতান, নবাব ও মুঘলরা হাজার বছর ধরে দুই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে বহুধাবিভক্ত রাজ্যগুলোকে একীভুত করে গ্রেটার ভারতবর্ষ গঠন করে শত শত বছরে ভারতকে একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ জনপদে পরিনত করতে সক্ষম হলেও পৌনে দুই শতাব্দীর বৃটিল ঔপনিবেশিক শাসন শেষে এই জনপদের মানুষের ঐক্যবদ্ধ থাকার আর কোনো সম্ভাবনাই অবশিষ্ট্য ছিল না। পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতমুখী অবস্থানের পেছনে ইন্ধন দিয়ে উপনিবেশোত্তর ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে টু নেশন থিউরি অনুসারে হিন্দু-মুসলমানের দেশভাগকে অনিবার্য করে তোলা হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের মাথায় পাকিস্তানের দুই অংশ অনিবার্যভাবেই বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। অন্যদিকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভৌগলিকভাবে না হলেও ভারতকেও ভেতর থেকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করে তুলেছে। ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দুর্বলতা থেকে এক ধরণের আগ্রাসি রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বের জন্ম দিচ্ছে, যা পুরো উপমহাদেশের রাজনৈতিক- সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির প্রভাবে বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার স্বপ্ন আভ্যন্তরীণ বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতার দ্বারা বার বার ক্ষতবিক্ষত ও বিপর্যস্ত হয়েছে। একাত্তুরের স্বাধীনতার বীজ ১৯০৫ সালের বাংলাভাগ কিংবা ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের নিড়ড়ে প্রোথিত ছিল। পাঞ্জাবি-বেলুচিস্তানি সামরিক ঊর্দির শাসনে পাকিস্তান কখনো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গ্রহণ করতে পারেনি। অধিকার সচেতন বাঙ্গালি মুসলমানের মনস্তত্ত্ব বুঝতে ভারত ও পাকিস্তানের আধিপত্যবাদী শাসকশ্রেণী বরাবরই অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের উপর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পশ্চিমের দূরত্বে থাকা রাওয়াল পিন্ডির নিয়ন্ত্রণ রুদ্ধ করে দিলেও দিল্লি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একাত্তরে স্বাধীনতার প্রশ্নে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলামসহ যে সব রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করেছিল, তাদের প্রধান শঙ্কা ও উদ্বেগের বিষয় ছিল, ভারত বাংলাদেশকে কখনোই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে দেবে না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধে নেমে লাখো প্রাণের বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হলেও স্বাধীনতাকামি মানুষের ভ্রম ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণের ক্ষণটি ছিল বাংলাভাষাভাষি মানুষের হাজার বছরের মাহেন্দ্রক্ষণ। নয়মাসের গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা মেজর এমএজি ওসমানি, মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ভারতকে পরাস্ত করেছিল। সে সব যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বীর সেনা অফিসাররা পাকবাহিনীতে নাস্তানাবুদ করে যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড যুদ্ধে যোগ দিয়ে বিজয়ের পুরোটাই ছিনিয়ে নেয়। ষোলই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বিপ্লবী বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতি ও ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার চুক্তির পক্ষ হিসেবে কিংবা সাক্ষী হিসেবেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের রাখা হয়নি। এটি ছিল ভারতের এক সুদূরপ্রসারি চক্রান্তের অংশ।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের উপর ভারতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল। যুদ্ধে অংশ নেয়া ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নজিরবিহিন লুটপাটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সম্ভাবনার ধ্বংসযাত্রা সূচিত হয়। সেই থেকে উদ্ভুত খাদ্যাভাব, দুর্ভীক্ষ, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, কোটি কোটি ডলারের বিদেশি অর্থ ও খাদ্য সহায়তা বল্গাহীন লোপাট হয়ে ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া, লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বপ্নভঙ্গ এবং ক্ষুধার্ত-বিক্ষুব্ধ জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গণতন্ত্রের গলা কেটে একদলীয় শাসন কায়েম করে মুজিবকে জনবিচ্ছিন্ন ও গণধিকৃত স্বৈরশাসকে পরিনত করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কি ভারতের কোনো দায় বা নেপথ্য ভূমিকা ছিল? এসব বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণামূলক তথ্য-উপাত্ত বিগত ৫৪ বছরে পাওয়া যায়নি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে যে সব গবেষণা, প্রকাশনা ও গ্রন্থাদি বেরিয়েছে তা থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সচেতন পাঠকের জন্য কঠিন কিছু নয়। কলকাতায় পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে শেখ মুজিবের হাতেখড়ি হয়েছিল। সত্তুরের নির্বাচনে জিতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। সে ম্যান্ডেট তাঁকে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাঁকে দিয়েছিল। ভুট্টো-ইয়াহিয়া খানেরা গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশকে অনিবার্য বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিলেও শেখ মুজিব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। ১ মার্চ পূর্ব নির্ধারিত পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করে দেয়ার পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার চাপে তিনি রেসকোর্সের জনসভায় ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বটে। কিন্তু ২৪ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে সমঝোতার আলোচনা চালিয়ে গেছেন। ঢাকার রাজারবাগ পুলিশলাইনে আর্মির ক্র্যাক-ডাউন ও শত শত পুলিশ সদস্য হত্যার রাতে শেখ মুজিব দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো দিক নির্দেশনা কিংবা স্বাধীনতার লিখিত-মৌখিক কোনো ঘোষণা না দিয়ে নিজ স্ত্রী-সন্তানদের পাক বাহিনীর জিম্মায় রেখে নিজে পাক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে করাচি চলে গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের রাজনৈতিক বক্তব্যের বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে দেশোদ্রোহীতার অভিযোগ আনা যায়, এমন কোনো ঝুঁকি তিনি নিতে চাননি। দেশের অন্যতম প্রবীণ বুদ্ধিজীবী, কলমযোদ্ধা বদরুদ্দিন ওমর মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলেন, এমনকি তিনি জানতেনও না যে দেশে এমন একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। লন্ডনে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা জানতে পারেন এবং সেখানে তাঁকে ধারণা দেয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। সেই তিন লাখকেই তিনি তিন মিলিয়ন আখ্যা দিয়ে তিরিশ লাখ শহীদের বয়ান সৃষ্টি করেছিলেন। শেখ মুজিব দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রিকনসিলিয়েশনের উদ্যোগ না নিলেও তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশগঠনে আত্মনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি ভুট্টোকে দাওয়াত দিয়ে ঢাকায় এনে লাল গালিচা সম্বর্ধনা দিয়ে পাকিস্তানের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক সৃষ্টি করা এবং ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং ভুট্টো ১৯৭৪ সালের জুনমাসে ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের উষ্ণ আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতির বদলে ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রচেষ্টার কারণে ভারতীয়রা শেখ মুজিবের রিজিমের প্রতি রুষ্ঠ ও বিরক্ত হতেই পারে। ভারতীয় শাসকশ্রেণী মনে করে, বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য ও ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক বয়ান স্বার্থের পরিপন্থী।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর বাংলাদেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতার বয়ান নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। একটা প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে হাজার হাজার মানুষ রক্ত দিয়ে ২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ভারতপন্থী হাসিনা রিজিমের পতন ঘটিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, একটানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা পঁচাত্তর বছরের পুরনো রাজনৈতিক দলের ছদ্মবেশি সমর্থক-সুবিধাভোগীরা এ বয়ানকে একাত্তরের ন্যারেটিভ দিয়ে খ-ন করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ন্যারেটিভকে গত ৫৪ বছর ধরে এ জাতিকে এমনভাবে গেলানো হয়েছে যে, আওয়ামী রাজনীতির সরাসরি প্রতিপক্ষ দলের অনেক নেতাকর্মী নিজেকে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি প্রমাণ করতে এখনো আওয়ামী ন্যারেটিভের বুলি আওড়াচ্ছে। তাদের প্রথমে এটা বুঝতে হবে যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যখন দেশের মানুষ তার মৌলিক অধিকারের জন্য হাজার হাজার মানুষকে রক্ত দিয়ে রিজিম চেঞ্জ করতে বাধ্য হয়, তখন একাত্তুরের বয়ান হাজির করে ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভ’ বর্তমান বাস্তবতায় আদৌ দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিনা? এই দেশে বাস করে, দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে কোনো ফর্মে রাজনীতি বা জনমত গঠন অসম্ভব ব্যাপার। একাত্তরের পর দেশের স্বাধীনতা নিয়ে যদি কোনো দল বা গোষ্ঠি কম্প্রোমাইজ করে থাকে, সেটা শেখ পরিবারের নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তারা একাত্তুর থেকে ২০২৪ সালে এসেও আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীসমর্থকদের প্রতারণা ও বিভ্রান্ত করছে। একাত্তুরে শেখ মুজিব নেতাকর্মীদের কোনো দিক নির্দেশনা না দিয়েই পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছিলেন, ২০২৪ সালে এসে শেখ হাসিনা নিজের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে দলের নেতাকর্মীদের কোনো রকম বার্তা বা নির্দেশনা না দিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে দিল্লিতে পালিয়ে গেলেন। তিনি পালিয়ে গিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি দিল্লিতে পালিয়ে গিয়ে দেশে থাকা নেতাকর্মীদের উস্কানিমূলক নির্দেশনা দিয়ে তাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে কণ্ঠিত হচ্ছেন না। এর মধ্য দিয়ে দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পাশাপাশি তিনি আবারো এটা প্রমাণ করছেন যে, তিনি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনের ধার ধারেন না, তিনি ভারতীয় হেজিমনি সফ্টপাওয়ার ও গোয়েন্দা অ্যাপারেটাস ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, গুম-খুন, হাজার হাজার কোটি টাকা তছরূপ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার শাস্তি এড়িয়ে দেশে পুনর্বাসিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আওয়ামী লীগকে তিনি প্রথাগত রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্যুত করে ভারতীয় আজ্ঞাবহ হয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখার সফ্ট পাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। দেশের সব বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিনত করেও তিনি নিরাপদ বোধ করতে পারেননি। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ভারতের বিশেষ বাহিনীর অংশগ্রহন, ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন অটুট থাকার মধ্যেও তাঁকে দিল্লিতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তার রেজিম থেকে মুক্তি পাওয়া মানে ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়া, এটাকেই ছাত্র-জনতা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করেছে। একাত্তুরে ভারতীয়রা আমাদের স্বাধীনতা হাইজ্যাক করে বিক্রি করে পাকিস্তানিদের সাথে দেনদরবারের পণ্যে পরিনত করেছিল। এবার কোনো দেশের সহায়তা ছাড়াই ছাত্র-জনতা নিজেদের রক্ত ঢেলে ভারতীয় আধিপত্যবাদের কবল থেকে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।
লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর পর দ্বিতীয় স্বাধীনতার বয়ান নিয়ে দেশে বিতর্ক হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগী অপরাজনীতির সুযোগ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে গেছে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক অমিমাংসিত ইস্যুর মিমাংসা এবং নিরপেক্ষ গবেষণামূলক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তি সংগ্রামীদের রক্তের মূল্যে কেনা জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল বন্ধুৃরূপী আধিপত্যবাদী শক্তির কেনাবেচার পণ্যে পরিনত হওয়ার উদাহরণ ইতিহাসে আরো আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব অগ্রাহ্য করে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে ভারতের অরোরার কাছে পাকিস্তানের একে নিয়াজির ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডারের মূল এজেন্ডা ছিল ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির মধ্যে। আত্মসমর্পনে গ্রেফতার হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধিসহ সব পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের নিরাপদে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিনিময়ে পাকিস্তানকে কাশ্মিরের লাইন অব কন্ট্রোল মেনে চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করা হয়েছিল। যুদ্ধের পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতের দখল করা কয়েকশ কিলোমিটার পাকিস্তানি ভূখন্ড ছেড়ে দেয়া হয় সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে। সিমলা চুক্তিকে অনেকটা ফিলিপাইন নিয়ে স্পেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্যারিস ট্রিটির সাথে তুলনা করা চলে। প্রায় সাড়ে ৩শ বছরের স্পেনিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিপিনোরা জোসে রিজাল এবং আন্দ্রেস বোনিফেসিও’র নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে ১৮৯৮ সালের শুরুর দিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ফিলিপাইনের স্বাধীনতা যুদ্ধ স্পেনিশ-আমেরিকান যুদ্ধে পরিনত হয়। আটমাস পর আগস্ট মাসে যুদ্ধে স্পেনিশদের সামরিক পরাজয় ঘটলে প্যারিসে একটি চুক্তির মাধ্যমে স্পেনিশরা ২০ মিলিয়ন ডলারে ফিলিপাইনের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করে। সেই সাথে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কিউবা, গুয়াম ও পোর্টেরিকোর নিয়ন্ত্রণও স্পেনিশরা আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ফিলিপিনোরা স্পেন-আমেরিকার ট্রিটি মেনে নেয়নি, তারা ডিসেম্বরে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ১৮৯৯ সালে ম্যানিলা যুদ্ধে উভয় পক্ষে বড় ক্ষয়ক্ষতির পর ফিলিপিনো জাতীয়তাবাদীরা গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তিন দশক ধরে যুদ্ধাবস্থা চলার পর ১৯৩৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ফিলিপিনো স্বাধীনতা আইন পাস করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ফিলিপাইন দখলের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পিছিয়ে যাওয়ায় যুদ্ধশেষে ১৯৪৬ সালে ম্যানিলা চুক্তির মধ্য দিয়ে সাড়ে তিনশ বছরের স্পেনিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং সাড়ে চার দশকের মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শাসনের পর ফিলিপাইন স্বাধীনতা লাভ করে। প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়ে স্পেনিশরা ফিলিপাইনের স্বাধীনতা বিক্রি করে না দিলে ১৮৯৮ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিল ফিলিপাইনের প্রথম স্বাধীনতা। সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারত পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করেছিল। আমাদের বাস্তবতায় লেখক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, ‘বেশিদামে কেনা কমদামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’। শেখ হাসিনার মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছিল। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গর্জনশীল রাইফেলের লক্ষ লক্ষ বুলেটের সামনে সিসাঢালা প্রাচীরের মত প্রতিরোধ গড়ে, জীবন দিয়ে রক্ত দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে ভারতীয় আধিপত্যবাদি রিজিমের পতন নিশ্চিত করে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ বিদেশি প্রভাবমুক্ত দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভ করেছে। এই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বহুমুখী চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।