অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বেশিরভাগ উপদেষ্টার মার্কিন ও পশ্চিমা নাগরিকত্ব, পশ্চিমা মদতপুষ্ট এনজিও সংশ্লিষ্টতা নিয়ে শুরু থেকেই নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। অনেকে এসব আলোচনা-সমালোচনাকে অতিরঞ্জিত কিংবা অহেতুক বলে উড়িয়ে দিলেও যতই দিন যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকান্ডে মার্কিন প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এরই সর্বশেষ নিদর্শন হিসেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত (ভারপ্রাপ্ত) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের বাসায় গিয়ে তার সাথে বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইতিপূর্বে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক হয়েছে। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠকের প্রসঙ্গটিকে অস্বাভাবিক বলে গণ্য করা যায়। এটি এমন সময় ঘটেছে, যখন বহুল প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানামুখী শঙ্কা দেখা দিতে শুরু করেছে। দীর্ঘ প্রায় এক বছরের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির দিনে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য টাইমলাইন প্রকাশের মধ্য দিয়ে দেশ নির্বাচনের ট্রেনে উঠলেও সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে জামায়াত, ইসলামি আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের ভিন্ন অবস্থান, এনসিপি নেতা নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না’ বলে যে হুমকি দিয়েছেন তার সাথে বিদেশি শক্তির ইন্ধন রয়েছে কিনা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। এর কারণ, গত সপ্তাহে এনসিপি নেতারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করে আসার পরই এ ধরনের হুমকি পাওয়া গেল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের দাবি অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশের সব রাজনৈতিক পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। এই কমিশনের দায়বদ্ধতা সরকার এবং জনগণের প্রতি। তারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে কেন সাক্ষাৎ করতে গেলেন এ বিষয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহি বা খোলাসা করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।
ভারতীয় আধিপত্যবাদী এজেন্ডায় দেড় দশক ধরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে ছাত্র-জনতা সহস্ত্র প্রাণের বিনিময়ে জুলাই অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশকে মুক্ত করেছে; দিল্লির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে ওয়াশিংটন বা অন্যকোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়। লাইনচ্যুত হয়ে পড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে যাত্রার শুরুতেই যখন নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার পক্ষে কিছু রাজনৈতিক দল ভিন্নমত ও ভিন্ন রকম কথাবার্তা বলছে, তখন তাদের সাথে মার্কিন দূতাবাসের বাড়তি খাতির সন্দেহের সৃষ্টি করছে। এ সন্দেহ আরো বেড়ে যায়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অ্যাকাডেমিসিয়ান ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অসঙ্গতভাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায় এবং সাক্ষাতের কারণ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে দেশের মানুষ কিছুই জানতে পারে না। ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের প্রতিশ্রুতি এবং সরকারের কর্মকা- সঠিক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কনভোকেশনের সম্বর্ধনা ও সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যসহ একাধিক বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী এনসিপি নেতারা বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছেন। জামায়াতসহ আরো কয়েকটি দলের নেতারা পিআর পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ঘোলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় নির্বাচন নিয়ে একটি অনিশ্চয়তার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সামগ্রিক বাস্তবতায় কেউ কেউ আরেকটি এক-এগারোর মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভেতরে ভেতরে ভিন্ন কোনো অভিসন্ধি বাস্তবায়ন করতে চাইছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। দেশের নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামের নাগরিক ফোরামের ব্যানারে দেশের প্রসিদ্ধ স্পষ্টভাষী রাষ্ট্র চিন্তক বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ বদরুদ্দিন ওমর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। বিগত সময়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন ভিত্তি লাভের পেছনে ইন্দো-মার্কিন সমঝোতা ও নিরব সমর্থন অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রশ্নে জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সমর্থনের কথা বললেও জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়েনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং দ্রুততম সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা বা অস্বচ্ছতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকটি জনমত জরিপের ফলাফল, নির্বাচনের শর্ত এবং টাইমলাইন নিয়ে কতিপয় রাজনৈতিক দলের নতুন বিতর্ক, পশ্চিমা মদদপুষ্ট এনজিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অতিতৎপরতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হতে দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পক্ষে বদরুদ্দিন উমর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর উপযাচক হয়ে মার্কিন দূতাবাসে যাতায়াতেরও সমালোচনা করেছেন। জুলাই অভ্যুত্থান ভারতের তাবেদার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটানোর সাথে সাথে ৫৪ বছর ধরে চলা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছিল। তবে ঢিমে তালে সংস্কারের নামে নির্বাচনকে প্রলম্বিত করে দেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে পুরনো বন্দোবস্ত ফিরিয়ে আনার যে কোনো কারসাজি ও ষড়যন্ত্র জনগণ বরদাশত করবে না। ঐকমত্য কমিশনসহ সংস্কার কমিশনগুলোর কার্যক্রমে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে ঘোষিত নির্বাচনের টাইমলাইন ও সম্ভাব্য রোডম্যাপ বিঘ্নিত হতে পারে, এমন যে কোনো উদ্যোগ থেকে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।