মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক, নির্মম। যে শিশুরা কিছুক্ষণ আগেও ছিল প্রাণোচ্ছল, প্রিয় প্রাঙ্গণে ছিল আনন্দমুখর, সেই হাসিখুশি কোমল মুখগুলোই মুহূর্তে পুড়ে নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পড়ে থাকল দগ্ধ মৃতদেহ। আশপাশের বাতাস ভারী হলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও তাদের স্বজনদের আর্তচিৎকারে।

একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স ছুটতে থাকল দগ্ধ শিশুদের নিয়ে। হাসপাতালগুলো ব্যস্ত হলো দগ্ধ ও আহত শিশুদের সেবায়। সেই হাসপাতালগুলোতেও শুধু আহাজারি আর আর্তচিৎকার। তাই আজ আমাদের শুধুই কান্নার দিন, শুধুই শোকে, বেদনায়, হৃদয়-যন্ত্রণায় মলিন হওয়ার দিন।

গত সোমবার উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে একটি প্রশিক্ষণরত যুদ্ধবিমান এসে আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে পুরো ভবনটি। গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে জানায়, গতকাল বিকেল পর্যন্ত অন্তত ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। দগ্ধ ও আহত হয়েছে প্রায় ২০০।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর থেকে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলটি দেশের মধ্যে নামকরা একটি স্কুল। প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, কচি-কাঁচা মুখগুলোর কলকাকলিতে মুখর থাকত এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। আজ সেখানে শুধুই সহপাঠী, পিতা-মাতা, শিক্ষক ও স্বজনদের বুকফাটা কান্না। সরকার মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে।

কল্পনাতীত শোকাবহ এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা। অন্যদের মধ্যে শোক জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানসহ আরো অনেকে। দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য বিমানবাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাসহ সেনাপ্রধান ও বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আমরা আশা করব, কেন দুর্ঘটনা ঘটল তার তদন্ত যেন সঠিকভাবে হয়।

দুর্ঘটনার পর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এবং অন্যান্য হাসপাতালে পুড়ে যাওয়া সন্তানের পাশে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন পিতা-মাতা, ভাই-বোন, সহপাঠীরা। সেখানে মেয়েকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ইয়াসমিন আক্তার। তাঁর ১১ বছরের মেয়ে নুরে জান্নাত ইউশার শরীর পুড়ে গেছে। ইউশা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তার কপাল পুড়ে গেছে, ঝলসে গেছে মুখমণ্ডল, মাথা ফেটেছে, পুড়ে গেছে পিঠও। এমন অবস্থা প্রায় সবারই।

গণমাধ্যমে উত্তরার এই দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। অনেক দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যে মডেলের বিমান উৎপাদক দেশ চীনসহ অনেক দেশেই আর ব্যবহার করা হয় না, তেমন একটি যুদ্ধবিমান কেন ঢাকার আকাশে উড়ানো হলো? মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছে। তার মধ্যে আছে, নিহতদের নামসহ সঠিক তথ্য প্রকাশ, আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো বিমান প্রশিক্ষণে ব্যবহার না করা। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে দাবিগুলোর যৌক্তিকতা স্বীকার করেন।

আমরা চাই, ভবিষ্যতে যেন এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়া হোক। হতাহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল আমাদের গভীর সমবেদনা।

২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশি সব পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসবে। এটি খাতভিত্তিক শুল্কের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগ হবে। উচ্চ শুল্ক এড়াতে যদি কোনো পণ্য ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়, তাহলে সেই পণ্যের ওপরও উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হবে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এক চিঠিতে এমনটা জানানো হয়েছে।

শুল্ক কার্যকর হতে মাত্র এক সপ্তাহের মতো বাকি রয়েছে। কিন্তু এখনো শুল্ক কমানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত চুক্তির বিপরীতে চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত অবস্থানপত্র যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরে পাঠানো হবে। আর তৃতীয় পর্যায়ে চূড়ান্ত বৈঠকের জন্য সময় চেয়ে আজ বুধবার তাদের ই-মেইল করা হবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে গত ৪০ বছরে এমন সংকট দেখা যায়নি। বাণিজ্যসচিব জানান, ১৯৪৯ সালের পর সারা বিশ্বে এ ধরনের পাল্টা শুল্ক কখনো আসেনি। এত দিন উন্নত দেশগুলো শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত সুবিধা দিয়ে গরিব দেশগুলোকে সহায়তা করত, এবার যুক্তরাষ্ট্র সেখানে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। উদ্যোক্তাদের মতে, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা ও দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।

তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞদের না রাখাই এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি ছিল তৈরি পোশাক। পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।

এই খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর একটি ভিয়েতনাম। দেশটির আমদানিপণ্যের ওপর প্রথমে ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সফলভাবে আলোচনার মাধ্যমে তারা সেই শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সমঝোতা না হলে বাংলাদেশকে ভিয়েতনামের চেয়ে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এটি বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অনেক কমিয়ে দেবে এবং রপ্তানি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত ও পাকিস্তানও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের শুল্কও কমতে পারে বলে নানা সূত্রে জানা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রধান রপ্তানি খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৪০ লাখ শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই খাতের সহযোগী শিল্পগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান আলোচনায় আরো দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

সূত্র, কালের কন্ঠ