রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বি এক কিশোর ফেইসবুকে মহানবী(সা.) এর প্রতি অবমাননাকর পোষ্ট দেয়ার পর স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ উক্ত কিশোরকে গ্রেফতার করে। ঘটনাটি আইনগত প্রক্রিয়ায় নিস্পত্তি হওয়াই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু নেপথ্যের একাধিক স্বার্থান্বেষী মহল মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে উত্তেজনা ও ভীতি ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ি ইউনিয়নের আলদাদপুর বালাপাড়া গ্রামের অভিযুক্তকে শনিবার রাতে পুলিশ আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর পার্শ্ববর্তী গ্রামের শতাধিক লোক লাঠিসোটা নিয়ে অভিযুক্ত রঞ্জন কুমারের বাড়িসহ কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। প্রায় ১৫টি টিনের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্যে জানা যায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল টিম এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত কিশোরের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে একটি মামলা এবং হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় অজ্ঞাত বহুসংখ্যক মানুষকে আসামী করে আরেকটি মামলা হয়েছে বলে গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে তৃতীয় পক্ষের অপপ্রচার, অপরাজনীতি ও ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের তৎপরতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। এসব তৎপরতা নিছক স্থানীয় বাসিন্দাদের উত্তেজনা কিংবা সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বহি:প্রকাশ নয়। ঘটনার পর আলদাদপুর বালাপারা গ্রামের মুসলমানরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের বাড়িঘর পাহারা দিয়েছে বলে জানা যায়। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার রিজিম পতনের পর থেকেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও উত্তেজনা সৃষ্টির নানামুখি, নানামাত্রিক তৎপরতা দেখা গেছে। তথনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হিন্দু মন্দির ও বাড়িঘর পাহারা দিয়েছে। গঙ্গাচড়ার ঘটনায় রঙ চড়িয়ে অপপ্রচার ও দেশবিরোধি অপতৎপরতা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

বিগত আওয়ামী আমলেও বিভিন্ন সময়ে ফেইসবুকে ইসলাম বিদ্বেষি পোষ্ট দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে দেশবিরোধি অপপ্রচারের মচ্ছব দেখা গেছে। সে সব ঘটনায়ও একাধিক মামলা হলেও ঘটনার নেপথ্যের কুশীলবরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। গঙ্গাচড়াও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশ এক রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের অপতৎপরতার পাশাপাশি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি মহল নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ফেইসবুকে ইসলাম বিদ্বেষি পোষ্ট দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে দেশবিরোধি অপপ্রচারে নতুন মাত্রা যুক্ত করা, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার কারসাজিও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। গঙ্গাচড়ায় তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশি হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত ও নিরাপদ হলেও এক শ্রেণীর স্থানীয় টিকটকার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও ইউটিউবার অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়িয়ে ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভীতি ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অতীতেও এ ধরনের ঘটনার অতিপ্রচার মোকাবেলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন তাক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত করে দিয়েছে এবং ক্ষতিপুরণের আশ্বাস দিয়েছে। অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভয় দেখিয়ে এবং সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায়ের প্রলোভন দেখিয়ে ক্ষতির পরিমান বাড়িয়ে বলা এবং বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে স্বার্থান্বেষি মহল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বাঁধা দিচ্ছে বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে।

এ সরকারের শুরু থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা ও দুর্বলতার সুযোগে সারাদেশে মব সন্ত্রাস দেখা দিয়েছে। গঙ্গাচড়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের প্রচেষ্টা এবং অপপ্রচারের সাথে যুক্তদের নেপথ্যের পরিচয় ও উদ্দেশ্য এখনো অজানা। তাদের মুখোশ উন্মোচন করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একেকটা গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর মব জাস্টিস বলে অপরাধিদের বিচারের বাইরে রাখা হয়েছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজির সাথে ফ্যাসিবাদ বিরোধি আন্দোলনের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক অংশীজনরাও জড়িয়ে পড়েছে। সব খরব গণমাধ্যমে উঠে আসছে না। জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় রাজধানীতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে কে বা কারা পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাচ্ছে বলে নানা মাধ্যমে খবর বের হলেও এর সাথে কারা কিভাবে জড়িত, তাদের আইনগত ম্যান্ডেট কি, এসব বিষয় এখনো অস্বচ্ছ। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের এতবড় একটা স্থাপনা নিয়ে কোনো পক্ষের মতলবি কার্যকলাপ নিয়ে সরকারের নিস্ক্রিয়তা অপ্রত্যাশিত। গঙ্গাচড়ার ঘটনা নিয়ে অপপ্রচার ও অপরাজনীতির তৎপরতা এখনো চলছে। একদিকে তথাকথিত ব্লগার, ইউটিউবার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথেচ্ছ ভিউ ব্যবসার বলি হচ্ছে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্র, অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচারের দোসর, ভারতের গদি মিডিয়া এসব ঘটনা নিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে অপতথ্য প্রচার করে দেশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সাইবার অপরাধ দমনে দেশে সাইবার সিকিরিটি ইউনিট রয়েছে। স্পর্শকাতর বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি সতর্কতা ও সক্রিয়তার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও গঙ্গাচড়ার ঘটনায় স্থানীয় সাইবার সিটিউরিটি টিমের বিরুদ্ধে নির্লিপ্ততার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগি ও গণমাধ্যম কর্মীদের কেউ কেউ। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। রাসূলের অবমাননা করে ফেইসবুকে পোষ্টদাতা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত রঞ্জন কুমারকে রিমান্ডে নিয়ে উস্কানিমূলক ফেইসবুক পোষ্টের নেপথ্যে কোনো ইন্ধন বা চক্রান্ত থাকলে তা খুঁজে বের করতে হবে। একইভাবে যারা সংঘবদ্ধ হয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে এবং হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উস্কানিমূলক তৎপরতা চালিয়েছে তাদেরকেও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ১২শ মানুষকে আসামি করে মামলার খবর প্রকাশিত হয়েছে। অজ্ঞাতনামা সহশ্রাধিক মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে গণগ্রেফতার বা হয়রানির শিকারে পরিনত করার যে কোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে গত চারদিনেও প্রকৃত অপরাধিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিচার নিশ্চিত করতে গিয়ে নিরপরাধ মানুষ হয়রানি-অবিচারের শিকার হোক, এমনটা কারো কাম্য নয়।

সূত্র, ইনকিলাব