গাজীপুরে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের হাতে পরপর দুই দিনে এক সাংবাদিক খুন এবং আরেক সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত বৃহ¯পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার আগের দিন বুধবার সাহাপাড়া এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের সামনে দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার আনোয়ার হোসেনকে চাঁদাবাজরা বেধড়ক মারধর করেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশ জানিয়েছে, গাজীপুরে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। অনেকের মতে, এই তাদেরকে মবত্রাস সৃষ্টি করে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে। দুই সাংবাদিককে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা খুন এবং পিটিয়ে আহত করার ভয়াবহ এই ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তরা কতটা বেপরোয়া ও দুর্বিণীত হয়ে পড়েছে, তা এই দুই ঘটনা সাক্ষ্য দিচ্ছে। যেখানে সাংবাদিকরা নিরাপদে ও নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কতটুক, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পরপরই সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের এই দুই ঘটনা ঘটেছে। পর্যবেক্ষকরা এ ঘটনাকে নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তোলার আলামত হিসেবে দেখছেন। দেশি-বিদেশি যেসব গোষ্ঠী নির্বাচন বিলম্ব ও বানচাল করতে চায়, এসব ঘটনা তাতে ইন্ধন যোগাবে বলে তারা মনে করেন। একে পুঁজি করে নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলে তাদের অজুহাতকে ভিত্তি দেবে। অন্যদিকে, বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি অনিরাপদ দেশ হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে উপাত্ত হিসেবে যুক্ত হবে। গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার দোসর ভারতীয় গণমাধ্যম অনবরত অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশকে একটি উগ্র মৌলবাদী দেশ হিসেবে তুলে ধরছে। ডানপন্থা, চরমপন্থা ইত্যাদির উত্থান ঘটছে বলে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও পত্রপিত্রকার প্রতিবেদনেও তা প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ যা নয়, তাই মনগড়াভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে, একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের বক্তব্য-বিবৃতিসহ অতি বাড়াবাড়ি এবং মব সন্ত্রাস এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এর সুযোগ নিচ্ছে, ভারত, পশ্চিমা মিডিয়া ও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। এসব অপপ্রচারের কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। অনেক দেশ বাংলাদেশীদের ভিসা দিতে চায় না। বাংলাদেশী পাসপোর্টকে তারা বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করছে। বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি নেতিবাচক ‘ক্যারেক্টার’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এসবই যে করা হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে ভন্ডুল করার লক্ষ্য নিয়ে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। অথচ বাংলাদেশ সারাবিশ্বে একটি ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ হিসেবে পরিচিত। সবাই জানে, হাজার বছর ধরে এদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পারস্পরিক সম্প্রীতির মাধ্যমে বসবাস করছে। কোনো ধরনের উগ্রপন্থাকে তারা প্রশ্রয় দেয় না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মসচেতন, তারা উগ্র নয়। ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের মদদপুষ্ট কিছু মিডিয়া এবং সংস্থা বরাবরই বাংলাদেশকে নেতিবাচক দেশ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে। এদেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও ভারতীয় এজেন্টরা বাংলাদেশে উগ্রবাদ, মৌলবাদ, চরমপন্থা ইত্যাদির উত্থান হচ্ছে বলে উসকে দিচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মকা-, মব সন্ত্রাস এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এই বদনাম করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তবে এসব ঘটনা যে, বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন নয়, তা সকলেরই জানা।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত হওয়ায় দেশজুড়ে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, পতিত আওয়ামী লীগ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য নতুন করে নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘাপটি মেরে থাকা পতিত স্বৈরাচারের দোসররা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশকে অনিরাপদ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। তাদের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। গাজীপুরের সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের সঙ্গে যারাই এই জঘন্য ঘটনার সাথে জড়িত থাকুক, রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক, তাদের দমনে সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে। আগামী নির্বাচনকে ঈদ উৎসবের মতো করা হবে বলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে এখন থেকেই সন্ত্রাসীদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এখানে ঢিমেতালে চলা বা বিচলনহীন থাকার কোনো সুযোগ নেই। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না। মব সৃষ্টি করে যারাই আইন নিজের হাতে তুলে নেবে, তাদের বিরুদ্ধে অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। নিজেদের নেতাকর্মীকে সতর্ক করার পাশাপাশি সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।