মঙ্গলবার বিকালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে। শহীদ ও গুমের শিকার পরিবারগুলোর স্বজন হারানো মানুষদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিল সেখানকার পরিবেশ। শহীদ পরিবারের সম্মানে ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা সভায় এ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বিগত শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যসহ সরকারি লোকজনদের দ্বারা গুম ও হত্যার শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবার-পরিজনরা বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছেন। তাদের কষ্ট অনুধাবন করা একমাত্র ভুক্তভোগীর পক্ষেই সম্ভব। তাদের কেউ হারিয়েছেন সন্তানকে, কেউ বাবাকে আবার কেউ হারিয়েছেন ভাইকে। অনেক নারীও গুমের শিকার হয়েছেন। এখন সময় এসেছে সেসব ঘটনার সুরাহা করার, সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে।
বস্তুত বিগত সরকারের আমলে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। সেই নির্যাতন কতটা ভয়াবহ ও পৈশাচিক ছিল, তা উঠে এসেছে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কাছে গুম কমিশনের দাখিল করা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে। নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেতেন না গুমের শিকার নারীরাও। কেমন ছিল নির্যাতনের ধরন? গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিফটিং সিস্টেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হতো। কখনো ঝুলিয়ে পেটানো হতো, কখনো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হতো, কখনো দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক। নারীদের হাত দুই দিকে বেঁধে জানালার দিকে মুখ করে ঝুলিয়ে বিকৃতভাবে উল্লাস করা হতো। গুম কমিশনে দেওয়া অনেক ভুক্তভোগীর বর্ণনায় উঠে এসেছে বিভিন্ন পদ্ধতির এমন লোমহর্ষক নির্যাতনের চিত্র।
বস্তুত গুম-নির্যাতন ছিল বিগত সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে সংঘটিত সবচেয়ে গুরুতর অপরাধগুলোর একটি। বিগত সরকারের পতনের পর আয়নাঘরসহ গুম-খুনের নানা তথ্য বেরিয়ে আসায় স্পষ্ট হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ইন্ধনে এ ধরনের অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করত না। এককথায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের দায়িত্বের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, যারা এভাবে গুম করে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের বেশির ভাগ এখনো চাকরিতে বহাল রয়েছে। গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, তাদের কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভয়াবহ গুম সংস্কৃতি ফিরে আসবে।’
ভুক্তভোগীদের এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। আমরা মনে করি, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে গুমের সঙ্গে জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা উচিত। ভুলে গেলে চলবে না, বিনাবিচারে কাউকে আটক বা বন্দি রাখা বা গুম করা সম্পূর্ণ বেআইনি। একইসঙ্গে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ মানবতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। কাজেই দেশে এ ধরনের ঘটনা আর কখনো যেন না ঘটে, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে।