পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো অধ্যায় নেই, যেখানে তারুণ্যের অগ্রযাত্রায় আলোকিত হয়নি। ইসলামের ইতিহাসে হযরত আলী (রা.), হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.), হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রা.), হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.) প্রমুখের মতো আদর্শ তরুণরা চিরখ্যাতি অর্জন করেছেন। হযরত মা ফাতেমা (রা.), হয়রত আয়েশা (রা.), হযরত উম্মে সালমা (রা.) প্রমুখের মতো পুতপবিত্র তরুণীরা আদর্শ ও নৈতিকতায় পূর্ণ তারুণ্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। এভাবে তারুণ্যের জয়গানে পৃথিবীর স্থান, কাল, ভূখ- কোনো না কোনো সময়ে রাজমুকুট পরিধান করেছেন। অতীতের সমৃদ্ধ তরুণ প্রজন্মের ইতিহাসকে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ইতিহাসের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে পরিবার, সমাজ, দেশ সর্বোপরি বিশ্ববিবেককে হতাশ হতে হয়। কেননা তারুণ্যকে দেখে যেখানে মানুষের আশায় বুক বাঁধার কথা, সেখানে মানুষ তাদের দানবীয় রূপ দেখে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের এক অংশ প্রায় এক প্রকার মূর্তিমান দানব। হাতে মারণাস্ত্র, ক্ষুর, চাপাতি, হকিস্টিক, লোহার রড, লাঠি, এমন কোনো বেআইনি অস্ত্র নেই, যা তারা বহন করে না। সর্বনাশা ইয়াবা, হিরোইন, পেথেড্রিন, ফেন্সিডিল, মদ, ধূমপান ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে দানবীয় রূপ ধারণ করছে তারা।

অপরদিকে বড় ভাই কেন্দ্রিক তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি চর্চার বিকাশ তরুণদেরকে মহাদানবীয় শক্তিতে রূপান্তর করছে। তাদের দেখে মনে হয়, এখনই হামলা করে কারও না কারও জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেবে, যার ফলে মুহূর্তেই এ তরুণ প্রজন্মের কাছে দাঙ্গা হাঙ্গামা লাগানো, প্রতিপক্ষকে হত্যা করা, কিংবা ভাড়াটিয়া হিসাবে হত্যাকান্ড সংঘটিত করা সবচেয়ে সহজ কাজে পরিণত হয়েছে। মানবিক চিন্তা ও মানবিকতা তরুণ প্রজন্ম থেকে বিদায় নিয়েছে। মাদকাসক্ত এ তরুণ প্রজন্ম তাদের নেশার পণ্য যোগাড় করতে এমন কোনো কাজ নেই, তারা করছে না। সে ক্ষেত্রে তারা তাদের মানবীয় রূপকে বিসর্জন দিয়ে দানবীয় রূপকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে তারা ছিনতাই, অপহরণ ও ভাড়াটিয়া হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সে পেশায় নিজেকে একজন পরিণত ব্যক্তি হিসাবে পরিচয় দিতে সুশীল পোশাক পরিচ্ছদের বিপরীতে অশালীন ও অরুচিকর পোশাক, চুলের ডিজাইন করছে, যা যেকোন সভ্য সমাজের ভাবনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তার অরুচিকর বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়নের আগেই বাহ্যিক রূপ বলে দেয় সে কত ভয়ংকর। এমনি ভয়ংকর রূপে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মহিলাদের উত্ত্যক্ত করা, মোবাইল টান দেওয়া, ছিনতাই, জনসংর্কীণ এলাকায় নারী নির্যাতন, ইত্যাদি সাবলীল ও ভয়হীনভাবে করে যাচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে মানবতাবোধের বিলুপ্তি ঘটছে এবং বিকৃত মানসিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। মোবাইলের অপব্যবহার করে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমু, হোয়াটস অ্যাপস ইত্যাদি ব্যবহার করে তারা ভয়ংকর গ্রুপে সংঘটিত হচ্ছে। অপরিণত বয়সে স্কুল কলেজ ও মা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হোটেল, চাইনিজ রেস্তোরাঁ, পার্ক কিংবা সাইবার ক্যাফে পর্নো সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়ার পাশাপাশি অপ্রীতিকর অবাধ মেলামেশার প্রতি ধাবিত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে নীতি, নৈতিকতা, আদব, শিষ্টাচার ও লাজলজ্জা পরিহারের যে হিড়িক পড়েছে তা ভবিষ্যতে মহামারি আকার ধারণ করলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তা পুনরায় পরিশোধন করতে পারবে কিনা ভেবে দেখা দরকার।

যে তরুণ প্রজন্ম পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হওয়ার কথা, সততার সাথে পবিত্র জীবন যাপনের মাধ্যমে নীতি নৈতিকতাকে পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করার কথা, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় উন্নতি কল্পে যেখানে তারুণ্যের মেধাকে ব্যবহার করার কথা, নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে নিজেকে দেশের জন্য, দেশকে বিশ্বের জন্য অপরিহার্য সম্পদে পরিণত করার কথা, সেখানে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সম্পূর্ণ বিপরীত কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। তরুণ বয়সে যেখানে আত্মবিশ্বাস, সুচিন্তা, নৈতিকতা, পরিশীল ও গবেষণামূলক মন মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার সেখানে বিকৃত রুচির চর্চা, সামাজিক লাজলজ্জা পরিহার করে তরুণ তরুণীর অবাধ মেলামেশা সুশীল মানুষকে লজ্জিত করে তুলছে। ডিজিটাল যুগের কল্যাণে তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা ও পরস্পরের যোগাযোগ বিষয়টি এত বেশি চর্চা হচ্ছে, যা তার মেধা, মনন, স্বপন, শিরা, উপশিরা ও রক্তে মিশে গেছে। একজন তরুণের টোটাল চিন্তাশক্তির সিংহভাগ অযাচিত ও কুসংস্কৃতির চিন্তায় ভরপুর হয়ে পড়ছে, যার প্রভাবে তরুণ প্রজন্মের একাংশ অনিন্দ্রা, অপুষ্টি, খর্বদেহ, মেধাশূন্যতাসহ নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মেধাবিকাশ ও চিন্তার পরিধি সংকুচিত হয়ে আসছে। অতি আধুনিকতা ও অতি স্বাধীনতার নামে আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণীরা কোন বিপদজনক পথের দিকে পা বাড়াচ্ছে তা ভাবতে অবাক লাগে।

বিভিন্ন সমীক্ষার আলোকে বলা যায়, বর্তমান সমাজের তরুণ-তরুণীদের লাগামহীন বিপদগামিতার দিকে ধাবিত হওয়ার যে দৌড় শুরু হয়েছে তা অতি দ্রুত প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে সভ্য সমাজের দাবি নিয়ে বসবাস করা যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন অভিভাবক, উদ্বিগ্ন শিক্ষক সমাজ, উদ্বিগ্ন পুরো জাতি। মনোবিজ্ঞানের দাবি অনুযায়ী ১১-১২ বছরের এ সময়কালকে ঝড় ঝঞ্ছার সময়কাল বলা হয়। এসময়ে সন্তান পিতামাতা ও শিক্ষকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যায় থাকার কথা, সেখানে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের পরিবারের প্রতি অবাধ্যতা ও আনুগত্য হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি পড়ালেখার প্রতি অমনোযোগিতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। লক্ষ্যহীন গন্তব্যে স্বাধীন মনে খোলা আকাশে মুক্ত পাখির ন্যায় বিচরণকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। তরুণ শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটে, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ইমু, ইনস্টাগ্রাম ফেইসবুক এগুলোর মধ্যে বিচরণকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। ফলে পড়ালেখার প্রতি নিষ্ক্রীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেসবুকের কল্যাণে শিক্ষার্থীরা অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে উদাসীন। এমন তরুণ প্রজন্ম নিয়ে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ, উন্নতি অগ্রগতি কি হবে, তা ভেবে দেখা দরকার।

সূত্র, ইনকিলাব