অর্থনীতি ও নিরাপত্তার পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০ দেশ নিয়ে গঠিত সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স (আসিয়ান)-এ অন্তর্ভুক্ত হতে বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সদস্যপদ পেতে আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি মালয়েশিয়াকে সমর্থনের অনুরোধ করেছেন। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ সদস্যপদ পাওয়া যথেষ্ট কঠিন হবে। এর কয়েকটি কারণ তারা উল্লেখ করেছেন। পূর্ণ সদস্যপদ এমনকি পর্যবেক্ষক মর্যাদার অবস্থান পেতে বাংলাদেশের টেকসই রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর সাথে ব্যাপক যোগাযোগ ও আলোচনা এবং প্রশাসনিক বাধা অতিক্রম করতে হবে। এছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ তার মেয়াদের পর টিকে থাকা, স্থিতিশীল নেতৃত্ব, সুসংহত নীতি এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। সর্বোপরি, আসিয়ানের ১০ সদস্য রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একমত হতে হবে। এক্ষেত্রে, বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে তার কিছুটা মনোমালিন্য রয়েছে। উল্লেখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত এবং সদস্য দেশগুলোকে আস্থায় নিতে পারলে আসিয়ানের সদস্যপদ লাভে বাংলাদেশের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট হিসেবে অসিয়ান ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। দেশগুলোর সম্মিলিত অর্থনৈতিক শক্তি প্রায় সাড়ে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এর আকার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সদস্য দেশের মধ্যে রয়েছে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও ব্রুনাই। দেশগুলো এশিয়ায় অর্থনীতির চালিকাশক্তি হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে তারা পারস্পরিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়ে জোটবদ্ধ হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ নীতির অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় তারা নতুন নীতি অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কারোপ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা আপাতত স্বস্তিকর হলেও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ঘন ঘন বদল তা অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দিয়েছে। ফলে রফতানি বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা সমীচীন হবে না। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রফতানি বাজার সম্প্রসারণ করা অপরিহার্য। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ। এছাড়া ইউরোপের দেশগুলো রফতানির অন্যতম গন্তব্যস্থল। তবে বৈশ্বিক বাণিজ্যিনীতি যেভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের জন্য একরৈখিক বা একমুখী রফতানি বাজারের উপর নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ প্রেক্ষিতে, রফতানি নীতি ও বহুমুখী রফতানি বাজার খোঁজা জরুরি। গ্লোবাল রাজনীতি এখন অর্থনীতিনির্ভর হয়ে পড়েছে। পরাশক্তিগুলো যুদ্ধের মনোভাব থেকে সরে এসে ‘অর্থনৈতিকযুদ্ধ মুখী’ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এখন আর সমরাস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে নেই। তারা বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত। চীনের সাথে ভারতও বৈরি সম্পর্ক পাশ কাটিয়ে বাণিজ্য সম্পর্কের দিকে ধাবিত হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই দৃঢ় এবং উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অংশীদারিত্ব স্থাপিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেও চীনের সম্পর্ক সম্প্রসারিত হচ্ছে। কুয়েতের সাথে ঘনিষ্ট হচ্ছে। রাশিয়ার সাথে চীন ও ভারতের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছে। আফ্রিকান দেশগুলোতে চীনের বিনিয়োগ ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাথেও চীনের ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটি বিভিন্ন প্রকল্পসহ পানি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদারে পরিণত হয়েছে। আগামীতে এর আরও সম্প্রসারণ হবে। ইতোমধ্যে চীন তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে চীনের এগিয়ে আসা অত্যন্ত ইতিবাচক। অন্যদিকে, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের ঘনিষ্ট বন্ধু। দেশটিতে বহু বাংলাদেশী কর্মরত। তার জনশক্তিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। গত বছর মে মাসে প্রায় ১৭ হাজার কর্মী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। এর মধ্যে দেশটি ৭ হাজার কর্মী নিচ্ছে। এ উদ্যোগ বাংলাদেশের সাথে মালয়েশিয়ার সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুমুখী করা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হতে পারলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে অঞ্চলভিত্তিক কানেক্টিভিটি সৃষ্টি হবে। সড়ক পথেই একদেশের সাথে আরেক দেশের সংযোগ স্থাপিত হবে। এতে দেশগুলোর জনগণের সাথে জনগণের যেমন সম্পর্ক স্থাপিত হবে, তেমনি বিশাল আমদানি-রফতানি বাজার সৃষ্টি হবে। পারস্পরিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে পুরো অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের অর্থনীতিকে সম্প্রসারিত করার জন্য ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের তোষামোদী করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। এই নীতি কার্যকর হলে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আর একমুখী থাকত না। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতেও তা সম্প্রসারিত হতো। আগামী বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে রফতানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বঞ্চিত হবে। এতে দেশগুলোতে রফতানি ৭ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যাবে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। এটি অর্থনীতিতে বড় ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করবে। রফতানি কমে যাওয়ার এই শঙ্কা দূর করতে পারে বহুমুখী রফতানি বাজারের সন্ধান লাভ। এর অন্যতম হতে পারে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো। এই জোটের সদস্য হতে পারলে তা সহজ হয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, সদস্য হতে পারলে এই জোটের দেশে রফতানি ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ফলে ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানি সংকুচিত হওয়ার যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, এর মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা ও সম্প্রসারিত হবে। এ লক্ষ্য সামনে রেখে সরকারের উচিৎ, আসিয়ানের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো। এজন্য বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে চীন, মালয়েশিয়াসহ অন্যদেশগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা ও লবিং শুরু করা জরুরি। সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার যাতে বাধা হয়ে না ওঠে, এজন্য তার সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে সম্মতি আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ আসিয়ান-এর সদস্য হতে পারলে কূটনৈতিক অবস্থান যেমন উন্নত হবে, তেমনি রফতানি বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আঞ্চলিক শক্তি চীন ও ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।